Posts

Showing posts from 2025

তমলুকের কেলোমাল গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গাপূজা (The Ghosh Family Durga Puja in Kelomal Village, Tamluk)

Image
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের কাছে কেলোমাল গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গাপূজা প্রায় ৪৫০ বছরের প্রাচীন এক ঐতিহ্য। এটি কেবল একটি পারিবারিক পূজা নয়, বরং ধীরে ধীরে এটি পরিণত হয়েছে সমগ্র গ্রামের উৎসবে। এই পূজার প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানে জড়িয়ে আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং গভীর ভক্তি। ঘোষবাড়ির এই দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন বংশের পূর্বপুরুষ করুণাময় ঘোষ। মকরন্দ ঘোষের ১৯তম পুরুষ করুণাময় হুগলি থেকে এসে তমলুকের কেলোমাল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তবে তিনি খালি হাতে আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন কুলদেবী চণ্ডী দেবীর বিগ্রহ। কেলোমালে এসে তিনি কেবল দেবীর পূজা চালু করেননি, একইসঙ্গে কুলদেবতা রঘুনাথ জীউর মন্দির এবং দ্বাদশ শিবালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে সামান্য কয়েকটি অবশিষ্ট আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাড়ির আশেপাশে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত শিব মন্দির দেখা গেলো। এই পূজার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর বৃহৎ নন্দীকেশ্বর পদ্ধতি। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে মাত্র পাঁচটি বনেদি বাড়িতে এই বিরল পদ্ধতিতে পূজা করা হয়। এই তালিকায় ঘোষবাড়ির পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের যশোরের একটি বনেদি বাড়ি এবং পশ্চিমবঙ্গের শ...

সাদৃশ্য ও স্বাতন্ত্র্যে অনবদ্য: ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির (Barrackpore's Annapurna Temple: A Unique Blend of Similarities and Distinctions)

Image
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে অবস্থিত অন্নপূর্ণা নবরত্ন মন্দিরটি এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ১৮৭৫ সালের ১২ই এপ্রিল, রানি রাসমনির ছোট মেয়ে জগদম্বা দেবী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের উদ্বোধনে স্বয়ং ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব উপস্থিত ছিলেন, যা এর পবিত্রতা ও গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জানা যায়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মোট চারবার এই মন্দিরে এসেছিলেন – স্থান নির্বাচন, ভিত্তি স্থাপন, প্রতিষ্ঠা দিবস এবং উল্টোরথের দিন। ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের এক সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পাওয়া যায়, কারণ দুটি মন্দিরই একই স্থপতির পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। তবে অন্নপূর্ণা মন্দিরটি উচ্চতার দিক থেকে ভবতারিণী মন্দিরের চেয়ে কিছুটা বেশি উঁচু। পূর্ব দিকে একটি সিংহমূর্তিযুক্ত লোহার ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমে নাটমন্দির এবং তার পাশেই মূল অন্নপূর্ণা মন্দিরটি চোখে পড়ে। মন্দিরের পশ্চিম দিকে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত পাশাপাশি ছয়টি আটচালা শিবমন্দির রয়েছে, যেখানে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এই ছয়টি শিবমন্দিরের মাঝখান থেকে একটি রাস্...

গুপ্তিপাড়া এবং গুপ্ত বৃন্দাবন: এক ঐতিহাসিক জনপদের স্পন্দন (Guptipara and Gupta Brindaban: The Pulse of a Historic Settlement)

Image
হুগলী জেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, বর্ধমানের সীমানায় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া কেবল একটি জনপদ নয়, এটি বাংলার এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। এই স্থানটি তার প্রাচীনত্ব, সাংস্কৃতিক অবদান, এবং রথযাত্রার জন্য কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিক্ষা, শাস্ত্রচর্চা, এবং গ্রন্থ রচনার কেন্দ্র হিসেবে এককালে গুপ্তিপাড়া সমগ্র বাংলায় উজ্জ্বল স্থান দখল করে ছিল। পুরীর রথের সঙ্গে তুলনীয় এর সুবিখ্যাত রথ ও রথের মেলা আজও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। প্রায় ১৫০০ শতাব্দীর শেষ দিকে গুপ্তিপাড়া জনপদের সূচনা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, পান্ডুয়ার রাজা জালালউদ্দিনের শাসনামলে হিন্দুরা দেশত্যাগ করে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এই গ্রাম গড়ে তোলে। মাঝি-মাল্লা, মৎস্যজীবী ধীবর সম্প্রদায়, এবং বৈদ্যরাই (গোপতি বা গুপ্ত) এখানকার আদি বাসিন্দা ছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত ছড়াতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিখ্যাত ওলন্দাজ ভূ-পর্যটক জন স্প্লিনটার স্টাভরিনাসের ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের মানচিত্রে গুপ্তিপাড়াকে ভাগীরথীর ডানদিকে দেখা গেলেও, ঐতিহাসিকরা গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনকে এর একমাত্র কারণ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সত্যনারায়ণ কথা এবং ...

গোবিন্দ সেন লেনের চুনী মণি দাসীর রথযাত্রা: এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য (Chuni Mani Dasi's Rath Yatra on Gobinda Sen Lane: A Century-Old Legacy)

Image
বউবাজারের গোবিন্দ সেন লেন, কলকাতার বুকে এক প্রাচীন রথের সাক্ষী। এখানে চুনিমণি দাসী প্রতিষ্ঠিত ১২৫ বছরেরও বেশি পুরোনো একটি রথ, যা শুধু কাঠের কাঠামো নয়, বরং ধর্মীয় ভক্তি, শিল্পকলা এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত উদাহরণ। এই রথযাত্রা, যা একসময় রাজপথ দিয়ে যেত, এখন বাড়ির উঠোনে সীমাবদ্ধ হলেও, এর জৌলুস ও ভক্তি এতটুকুও কমেনি। চুনী মণি দাসীর রথটি পাঁচ চূড়াবিশিষ্ট এবং ত্রিতল। এর নির্মাণশৈলীতে সাবেক শিল্পরীতির সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। রথের চার কোণে চারটি পুতুল সজ্জিত এবং রথের গায়ে আঁকা আছে দেবদেবীর মন মুগ্ধ করা ছবি। এই কারুকার্যময় রথটি শুধু একটি বাহন নয়, এটি এক চলমান শিল্পকর্ম, যা সেই সময়ের শিল্পীদের দক্ষতা ও নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে। এই রথের মূল আকর্ষণ হলেন ভগবান জগন্নাথ। কথিত আছে, পুরীর নব কলেবরের সময় অতিরিক্ত নিম কাঠ দিয়ে যে জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি হয়েছিল, সেই নিমকাঠের একটি অংশ দিয়েই চুনী মণি দাসীর রথের জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই বিগ্রহের মধ্যে একটি শালগ্রাম শিলাও প্রতিষ্ঠিত আছে, যা এর পবিত্রতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই বিশেষত্বই এই পরিবারের জগন্নাথকে এক অনন...

মুর্শিদাবাদের ওয়াসিফ মঞ্জিল: এক বিস্মৃত ইতিহাসের জীবন্ত দলিল (Wasif Manzil in Murshidabad: A Living Document of a Forgotten History)

Image
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, যখন ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সেই সময়ে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। প্রিন্স ওয়াসিফ আলি মির্জা, ইউরোপের মাটিতে দীর্ঘ পড়াশোনা শেষে এক আধা-ইংরেজ রূপে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মুর্শিদাবাদের মসনদে তখন তাঁর পিতা, নবাব হাসান আলি মির্জা। বিলেতের জীবনযাপনের প্রভাবে ওয়াসিফ আলি মির্জার রুচি ও জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছিল। তিনি ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদে বাস করতে চাইলেন না। কিন্তু নতুন প্রাসাদ নির্মাণের মতো আর্থিক সামর্থ্যও তাঁর ছিল না। ঠিক এই সময়ে ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে পুরনো প্রাসাদের একটি অংশ ভেঙে পড়েছিল। সেই ভাঙা অংশটিকেই সংস্কার করে তিনি এক নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার নামকরণ করেন নিজের নামানুসারেই – ওয়াসিফ মঞ্জিল। তখনও তিনি নবাব হননি। ১৯০৬ সালে পিতা নবাব হাসান আলি মির্জার প্রয়াণের পর প্রিন্স ওয়াসিফ আলি মির্জা নবাব বাহাদুর উপাধি ধারণ করেন। ওয়াসিফ আলি মির্জা এই প্রাসাদটি মূলত বসবাসের উদ্দেশ্যেই নির্মাণ করেছিলেন। তবে তাঁর ভাগ্যে এই প্রাসাদে দীর্ঘকাল বসবাস লেখা ছিল না। নবাব হওয়ার পর ...

কালের সাক্ষী দুই কামান: বাচ্চাওয়ালি ও জাহানকোষার সাথে মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য (Echoes of Time: The Legacy of Bachhawali and Jahan Kosha in Murshidabad)

Image
মুর্শিদাবাদের প্রাণকেন্দ্রে, ভাগীরথী নদীর শান্ত অথচ প্রবহমান স্রোতের পূর্ব তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক স্থাপত্যের বিস্ময় – হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। এই ত্রিতল অট্টালিকা কেবল একটি ইমারত নয়, বরং কালের সাক্ষী, নবাবী ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এর উত্তরে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ চত্বরের প্রান্তে শোভা পায় বাংলার বৃহত্তম ইমামবাড়া, যা মহরমের পবিত্র স্মৃতি বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। হাজারদুয়ারি এবং ইমামবাড়ার নিবিড় সান্নিধ্যে এক মনোরম প্রাঙ্গণে দৃষ্টিগোচর হয় শুভ্র মদিনা, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতিস্তম্ভ রূপে আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। এই মদিনাই সেই অস্থির সময়ের একমাত্র নীরব সাক্ষী। এর পাশেই কালের নীরব প্রহরী রূপে শায়িত রয়েছে এক বিশাল কামান – বাচ্চাওয়ালি তোপ, যা কেবল আকারে নয়, লোমহর্ষক কিংবদন্তীর জন্যও বিখ্যাত। শোনা যায়, নবাব হুমায়ুন জা যখন এই অঞ্চলের শাসনকর্তা, তখন এই লৌহদানব ভাগীরথীর গভীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বাচ্চাওয়ালি তোপের নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও বিতর্ক বিদ্যমান। কেউ মনে করেন ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দশ শতাব্দীর গৌড়ের কোনো অজ্ঞাত সু...

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ এবং তার প্রাঙ্গণে কয়েকটি দ্রষ্টব্য, মুর্শিদাবাদ (Hazarduari Palace and its Surroundings: Must-See Sights in Murshidabad)

Image
মুর্শিদাবাদ জেলার হাজারদুয়ারি প্রাসাদ হলো মুর্শিদাবাদের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। এই হাজারদুয়ারির আকর্ষণেই মুর্শিদাবাদে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন। তবে একটা বিরাট সংখ্যক মানুষের ধারণা, এটা বানিয়েছেন নবাব সিরাউদ্দৌলা। কিন্তু বাস্তবে, সিরাজের মৃত্যুর অনেক পর এটা বানানো হয়েছে। এটি বানিয়েছিলেন তৎকালীন নবাব নাজিম হুমায়ূন জা। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের স্থপতি কর্নেল ডানকান ম্যাকলিওড, ইটালিয়ান ধাঁচে এই প্রাসাদটি তৈরী করেন।  প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে আগস্ট, এবং কাজ সম্পুর্ণ হয় ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ৮০ ফিট উঁচু, দৈর্ঘ্যে ৪২৫ ফিট ও প্রস্থে ২০০ ফিট, তিনতলা এই প্রাসাদের নির্মাণকার্যে খরচ হয়েছিল প্রায় সাড়ে ষোলো লক্ষ টাকা। চুন সুরকির গাঁথনিতে ব্যবহার করা হয়েছিল প্রচুর পরিমাণে ডিমের কুসুম, মৌরী ভেজানো জল এবং খয়ের জল। প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে রয়েছে কালো ব্যাসল্ট পাথরের প্রশস্ত সিঁড়ি, এবং সিঁড়ির দুই পাশে রয়েছে সিংহের মূর্তি। সিংহের মূর্তির পাশে রয়েছে মাঝারি আকৃতির কামান।  এই প্রাসাদটি বানানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল দরবার পর...