Posts

মহিষা গ্রামের জাগ্রত সর্পদেবী মা মনসা: কৃষি ও লোকবিশ্বাসের প্রাচীন ধারা (Awakened Serpent Goddess Ma Manasa of Mahisha Village: An Ancient Stream of Agriculture and Folk Belief)

Image
এই লেখাটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মহিষা গ্রামের একটি খুব পুরোনো এবং জাগ্রত মন্দির নিয়ে, যা সর্পদেবী মা মনসার মন্দির নামে পরিচিত। এই মন্দিরে মানুষের বিশ্বাস অনেক গভীর এবং অনেক পুরনো। মন্দিরটি বেশিদিনের না হলেও এর পেছনের গল্প অনেক শতকের পুরনো। অনেক শত বছর আগে, এই জায়গাটা ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা, মহিষা নামের একটি ছোট গ্রাম। এই গ্রামটি এখন জকপুর এবং মাদপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাঝামাঝি রয়েছে। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন কৃষক। ফসল ভালো হলেও, তারা সবসময় সাপের ভয়ে চিন্তায় থাকতেন। তাই সাপের হাত থেকে বাঁচতে তারা সর্পদেবী মা মনসার পূজা শুরু করেন। বিশেষ করে "শ্রাবণ" এবং "ভাদ্র" মাসে, তারা সাপের কামড় থেকে রক্ষা পেতে মঙ্গলবার ও শনিবার মায়ের পূজা করতেন। তারা শুধু সাপের ভয় কাটানোর জন্য নয়, ভালো ফসলের জন্য মা-কে 'কৃষিদেবী' হিসেবেও পূজা করতেন। একবার খুব ভালো ফসল হওয়ার পর, সব কৃষক মিলে মায়ের পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা বনের একটি জায়গায় মায়ের পূজা শুরু করেন। প্রতি বছর ফসল কাটার পর, প্রত্যেক কৃষক তাদের ফসলের একটি আঁটি মাকে দান করতেন। ...

হাওড়ার চক্রবর্তী বাড়ির সর্বমঙ্গলা রূপের আরাধনা: পরম্পরা ও অলৌকিকতার মেলবন্ধন (The Worship of Sarbamangala at Howrah's Chakraborty Family: A Blend of Tradition and Divine Manifestation)

Image
পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার রামরাজাতলা অঞ্চলের বকুলতলা লেনের এক সংকীর্ণ গলি পথে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন বনেদি দুর্গা পূজার ঐতিহ্য – চক্রবর্তী বাড়ির পূজা। ‘রামরাজাতলা ভাই ভাই সংঘ’-এর সন্নিকটে অবস্থিত এই পরিবারটি, জমিদার না হয়েও, তাদের দুর্গোৎসবকে এক স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক মহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছে। এই বাড়িতে মা দুর্গা পূজিত হন ‘সর্বমঙ্গলা’ রূপে। এই পূজার সূচনা হয়েছিল ১৯৪১ সালে স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দ্বারা, তখন তিনি ছিলেন ঝিকিরার বাসিন্দা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সকল সদস্যরা রামরাজাতলার এই বকুলতলা লেনে স্থানান্তরিত হন। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে এক অলৌকিক বিশ্বাস। লোকমুখে প্রচলিত, মা কালীর স্বপ্নাদেশেই চক্রবর্তী পরিবারে ‘বুড়িমা’ ও ‘মা মঙ্গলা কালীর’ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সেই মায়ের নির্দেশেই এখানে দুর্গাপূজাও শুরু হয়। একারণেই স্থানীয়দের কাছে এই বাড়িটি কেবল দুর্গাপূজার স্থান নয়, বরং ‘মঙ্গলা কালীর মন্দির’ হিসেবেও পরিচিত। গলির ভেতরে এই বাড়ির অবস্থান খুঁজে বের করা কিছুটা কঠিন হলেও, এই পরিবারের সদস্যদের অমায়িক ব্যবহার তা সহজেই ভুলিয়ে দেয়। প্রথম দিকে এই আরাধনা শুরু হয়েছিল ...

উত্তর হাওড়ার ঢ্যাং পরিবার: বাটখারা থেকে বনেদি দূর্গাপূজা, এক অসামান্য ঐতিহ্যের দেড়শো বছর (The Dhang Family of North Howrah: From Weights to a Venerable Durga Puja, One Hundred and Fifty Years of Extraordinary Heritage)

Image
উত্তর হাওড়ার সালকিয়া অঞ্চলের এক আলোকিত ইতিহাস বহন করে চলেছে ঢ্যাং পরিবার এবং তাদের সুপ্রাচীন দুর্গাপূজা। যে পরিবারের পূর্বপুরুষের নাম অনুসারে হাওড়া স্টেশন থেকে সালকিয়া পেরিয়ে বাবুডাঙ্গার মোড়ের ডানদিকে বাঁক নেওয়া পথটি 'শ্রীরাম ঢ্যাং রোড' নামে পরিচিত, সেই ঢ্যাং বংশের শিকড় প্রোথিত ছিল হুগলি জেলার খানাকুলের নিকটবর্তী ঝিংড়া গ্রামে। যদিও এই বংশের মূল পদবী 'দে', কিন্তু 'ঢ্যাং' উপাধি প্রাপ্তির কারণ আজও লোকচক্ষুর আড়ালে। আদিপুরুষ গুরুদাস ঢ্যাং-এর পুত্র লক্ষ্মণ শাঁখার ব্যবসা করতেন। লক্ষ্মণ এবং তাঁর পুত্র শ্রীরাম ঢ্যাং প্রথম ঝিংড়া গ্রাম থেকে সালকিয়াতে এসে বসতি স্থাপন করেন। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে শ্রীরাম ঢ্যাং সালকিয়াতে প্রতিষ্ঠা করেন পিতলের ঢালাই কারখানা, যেখানে তিনি ওজন করার বাটখারা তৈরি করে দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছন। শ্রীরাম ঢ্যাং-এর পাঁচ পুত্র, দেবেন্দ্রনাথ, মহাদেব, শিবচন্দ্র, রাখালচন্দ্র এবং তারকনাথ, পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যৌথ ব্যবসায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তারা ঢালাই কারখানার পাশাপাশি তেল ও তুলোর ব্যবসা শুরু করেন এবং সুইডেনে তৈরি 'টেক্কামার...

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেয় দুর্গাপুজো: সালকিয়া হাউসের বনেদি ঐতিহ্যের আখ্যান (Durga Puja at the Ancestral Home of Pulak Bandyopadhyay: The Story of Salkia House's Noble Heritage)

Image
হাওড়া বাঁধাঘাটের কাছেই, শ্রীরাম ঢ্যাং রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনার চোখে পড়ে যাবে একটা পুরোনো সাদা প্রাসাদোপম বাড়ি, যার গেটের বাইরে একটা দিকে লেখা আছে শালিখা হাউস, আর অন্যদিকে সালকিয়া হাউস। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে মনের দৃশ্যপটে ভেসে আসবে অতীত থেকে ভেসে আসা কিছু বাংলা গানের সুর এবং একজন বিখ্যাত সুরকারের নাম... শ্রী পুলক বন্দোপাধ্যায়।  এই সালকিয়ার বন্দোপাধ্যায় বাড়ি যেমন বিখ্যাত বাঙালির এই গর্বের সুরকারের জন্য, তেমনই বিখ্যাত এর দুর্গাপুজো। পুজো শুরু হয়েছিল ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে, বাড়ির পূর্বপুরুষ জমিদার শ্রী রাধামোহন বন্দোপাধ্যায়ের আমলে। তবে পরিবারটি সমৃদ্ধি লাভ করে শ্রী রসিক কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের আমলে। একটা সময় সালকিয়া বাজারটি এনাদের পরিবারের মালিকানাধীন ছিল। তবে বর্তমানে আর্থিক কারণে ভাটা পড়েছে আড়ম্বরে। তাও নিষ্ঠাভরে এনারা প্রায় ২৫০ বছর ধরে দুর্গাপূজা করে আসছেন। এবার আসা যাক পুজোর বিবরণে। বাড়ির ঠাকুরদালানে তৈরি হয় একচালার প্রতিমা। মহালয়ার পরের দিন দেবীর বোধন হয়, নিজস্ব ঠাকুরঘরে হয় চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীর দিনে সন্ধ্যায় বেলবরণ দিয়...

রাধামাধব ধাম: উত্তর হাওড়ার ঘোষ বাড়ির ইতিহাস ও দুর্গাপূজার প্রথা (Radhamadhav Dham: The History and Durga Puja Traditions of the Ghosh Family of North Howrah)

Image
হাওড়া ময়দান থেকে জি.টি. রোড ধরে উত্তর হাওড়ার পিলখানা স্টপে নেমে, হাঁটছিলাম একটা ঘিঞ্জি গলিরাস্তা ধরে, যার বর্তমান নাম কে. সি. ঘোষ রোড হলেও, পুরোনো নাম ওয়াটকিনস লেনের নামেই সবাই চেনে। এই রাস্তাটা ধরে সোজা চলে গেলে পড়বে হাওড়া এসি মার্কেট। মার্কেটে পৌঁছানোর একটু আগেই বাম দিকে চোখে পড়বে দালান রীতিতে বানানো মন্দিরসহ একটি বড়ো বাড়ি, যার নাম 'রাধামাধব ধাম'। বাড়ির ঠিকানা ১ নং কে. সি. ঘোষ রোড, হাওড়া ৭১১১০১। বাড়িটি ঘোষেদের ঠাকুরবাড়ি। এখানে সারাবছর রাধামাধব পূজিত হন এবং এই বাড়ির দুর্গাপুজো যথেষ্ট পুরোনো। তবে বাড়ির এবং পুজোর ইতিহাসের পুরোটা জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে পলাশীর যুদ্ধের সময়কালের একটু আগে।  ঘোষেদের জমিদারি ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের কাকদাড়ি গ্রামে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি প্রবল আনুগত্যের কারণে, তারা 'পালমল' উপাধি পেয়েছিলেন নবাবের থেকে। জমিদারি ঠিকঠাক চললেও, হঠাৎ করে পরিবারের সদস্য ফকির চন্দ্র ঘোষের অকালমৃত্যু-তে পরিস্থিতি পাল্টে যায়, এবং তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র মাধব চন্দ্র ঘোষ পরিবারে অবহেলিত হতে শুরু করেন। তাই পারিবারিক বাড়ি ...

মধ্য হাওড়ার কালীবাবুর বাজারের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুই দুর্গা পূজা (The Two Traditional Durga Pujas of the Bandyopadhyay Family at Kalibabu's Market, Central Howrah)

Image
মধ্য হাওড়ার কালীবাবুর বাজারের প্রসিদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপূজা শুধু প্রাচীনই নয়, এর রয়েছে এক বিশেষ ঐতিহ্য। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো এই পূজা। তবে এই বাড়ির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, একই পরিবারে হয় দুটি প্রতিমার পুজো—যা প্রাচীন পুজো ও নতুন বাড়ির পুজো নামে পরিচিত। নিয়মনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই দুই পুজো অভিন্ন, এবং দেবী বিসর্জনও হয় একসঙ্গে। পুজোর এই দিনগুলিতে পুরো বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার একজোট হয়ে উৎসব পালন করে। মধ্য হাওড়ার সমৃদ্ধিতে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অবদান আজও মুখে মুখে ফেরে। এই পরিবারের আদি প্রাণপুরুষ ছিলেন গিরীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মধ্য হাওড়ার জমিদারি লাভ করেন, উত্তর কলকাতার রাজবল্লভ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সূত্রে। তাঁর মধ্যমপুত্র কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, যার নামে হাওড়ার একটি বিশাল বড় বাজার ও রাস্তা রয়েছে। এনাদের দুর্গামন্দিরের সাথেই একটি গোপাল জিউ এর মন্দির আছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে লেখা আছে আনুমানিক ১০৫০ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ। তবে এটি অনেক পরের ফলক (সম্ভবত সংস্কারের সময়...

তমলুকের কেলোমাল গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গাপূজা (The Ghosh Family Durga Puja in Kelomal Village, Tamluk)

Image
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের কাছে কেলোমাল গ্রামের ঘোষবাড়ির দুর্গাপূজা প্রায় ৪৫০ বছরের প্রাচীন এক ঐতিহ্য। এটি কেবল একটি পারিবারিক পূজা নয়, বরং ধীরে ধীরে এটি পরিণত হয়েছে সমগ্র গ্রামের উৎসবে। এই পূজার প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানে জড়িয়ে আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং গভীর ভক্তি। ঘোষবাড়ির এই দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন বংশের পূর্বপুরুষ করুণাময় ঘোষ। মকরন্দ ঘোষের ১৯তম পুরুষ করুণাময় হুগলি থেকে এসে তমলুকের কেলোমাল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তবে তিনি খালি হাতে আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন কুলদেবী চণ্ডী দেবীর বিগ্রহ। কেলোমালে এসে তিনি কেবল দেবীর পূজা চালু করেননি, একইসঙ্গে কুলদেবতা রঘুনাথ জীউর মন্দির এবং দ্বাদশ শিবালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে সামান্য কয়েকটি অবশিষ্ট আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাড়ির আশেপাশে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত শিব মন্দির দেখা গেলো। এই পূজার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর বৃহৎ নন্দীকেশ্বর পদ্ধতি। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে মাত্র পাঁচটি বনেদি বাড়িতে এই বিরল পদ্ধতিতে পূজা করা হয়। এই তালিকায় ঘোষবাড়ির পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের যশোরের একটি বনেদি বাড়ি এবং পশ্চিমবঙ্গের শ...