শোভারাম বসাকের জগন্নাথ মন্দির ও ঘাট (Jagannath Temple and Bathing Ghat of Sovaram Basak)

কোলকাতার স্ট্রান্ড রােডের পুরানাে মিন্টের লাগােয়া একটা গলি রাস্তা দেখা যায়, যার নাম 'নবাব লেন'। ছোট এই লেনটি গিয়ে শেষ হিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্র রােডে। নবাব লেন ও
মহর্ষি দেবেন্দ্র রােডের ঠিক সংযােগস্থলে (১নং নবাব লেন) রয়েছে একটি জগন্নাথ মন্দির, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শোভারাম বসাক।


মন্দির যে কবে তৈরী হয়েছে, সেটা নিয়ে কয়েকটা অভিমত চালু আছে। কোলকাতার বসাক বংশের শােভারাম বসাক ছিলেন সপ্তগ্রামের হলদিপুরের বাসিন্দা। সেখান থেকে ব্যবসাসূত্রে এসে তিনি গােবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করেন, এবং বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সুতাে ও কাপড়ের ব্যবসা করে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। সেই সময়েই শােভারাম এই জগন্নাথ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন নিজের বাড়িতে। পরবর্তীকালে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ নির্মাণের সময়ে শােভারামকে গােবিন্দপুর থেকে উঠে এসে বড়বাজারে বাড়ি করতে হয়, এবং সেখানেই নিজস্ব বাড়ির পশ্চিমদিকে, গঙ্গার তীরে এক মন্দির নির্মাণ করে জগন্নাথদেবকে প্রতিষ্ঠা করেন (এখানে মনে রাখতে হবে, তখন কিন্তু গঙ্গা প্রায় স্ট্রান্ড রোডের ওপরেই বইতো)। এছাড়া মন্দিরের পাশে স্নানার্থীদের জন্য যে ঘাটটি তিনি নির্মাণ করে দেন, তাই পরে জগন্নাথ ঘাট নামে বিখ্যাত হয়।

আবার আরেকটি মত বলছে, প্রায় দেড়শাে বছর আগে কলকাতার শােভারাম বসাক স্ট্রিটের বাবু শােভারাম বসাকের দ্বারা এই জগন্নাথ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়। এই হিসাব ধরলে খৃষ্টীয় আঠারাে শতকের মাঝামাঝি এই জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকাল বলে ধরা যেতে পারে।

পুরোনো কিছু তথ্য থেকে জানা যায়, পােস্তায় এই মন্দিরের রথযাত্রায় তিনটি বিরাট রথ বেরোতো। এই রথগুলো আবার সারা বছর রাখা থাকতো গরানহাটায় কৃষ্ণচন্দ্র সিংহের (লালাবাবু) বাড়ির উঠোনে। এই কারণে, অনেকেই একে লালাবাবুর মন্দির বলতেন।

এবার আসা যাক, শোভারাম কেন এই মন্দির বানাতে আগ্রহী হলেন। জানা যায়, কানােয়ার দাস বাবাজী নামে এক মহন্ত পুরীর শ্রীক্ষেত্র থেকে, এই জগন্নাথ বিগ্রহ নিয়ে হাঁটাপথে কোলকাতা এসে পৌঁছান। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমের কোনো শহরে এ বিগ্রহটির প্রতিষ্ঠা। যাত্রাপথে কোলকাতায় থাকার সময়, তিনি শোভারামের আতিথ্য-গ্রহণ করেন। জগন্নাথের রূপে মুগ্ধ হয়ে, শােভারাম বসাক বর্তমান স্থানে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। অনেক অনুরোধের পরে মহন্ত অবশেষে রাজি হন। শােভারাম বসাক খুশি হয়ে আজকের এই ঠিকানায় এই বিগ্রহের মন্দির তাে নির্মাণ করেই দেন, সাথে সেই মন্দির সংলগ্ন নদীতীরে স্নানার্থীদের জন্য একটি ঘাটও নির্মাণ করে দেন, যা পরে জগন্নাথ ঘাট নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ভাগীরথী আরও পশ্চিমে সরে যাওয়ায় সে ঘাটটি বিলুপ্ত হলেও, নদীর ধারে নতুন করে 'জগন্নাথ ঘাট' গড়ে তোলা হয়।


শােভারাম এই জগন্নাথ মন্দিরের সেবাপুজোর জন্য সাত
কাঠা জমি দেবােত্তর করে দেন। মন্দিরের প্রথম ও প্রধান সেবায়েত কানােয়ার দাস বাবাজীর দেহান্তের পরে সেবায়েত হন মৌজিরাম মহন্ত, তারপর যমুনাদাস মহন্ত। এদের পরবর্তী ভগবান দাস মহন্ত সেবায়েতী নিয়মভঙ্গ করে বিয়ে করেন। এর ফলে তার সেবায়েতপদ নাকচ হয়ে যায়, এবং সেই স্থলাভিষিক্ত হন হরদেব দাস মহন্ত। মজার কথা হলো, বর্তমান মন্দির কমিটি অবশ্য শােভারাম দ্বারা জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বেমালুম অস্বীকার করেন!

বর্তমানে মন্দির ও ঠাকুর শােভারাম বসাকের উত্তরাধিকারীদের দখলে আর নেই, বরং তা সেবায়েতদের কুক্ষিগত হয়েছে। প্রায় আড়াইশাে বছরের প্রাচীন এই জগন্নাথ মন্দিরটির পুরানাে আকৃতিও আজ বজায় নেই। কারণ সাবেকি মন্দিরটি কোনো কারণে ধ্বংস হলে, পরবর্তী সময়ে আমূল সংস্কার করা হয়েছে চুনার থেকে আনা লালচে রঙের পাথর বসিয়ে। স্থাপত্যটি হয়ে গেছে উত্তর ভারতীয় নাগর শৈলীর অনুকরণে নির্মিত
নবরথপগযুক্ত এক শিখর মন্দির। জানা গেল, আগের মন্দিরটি ভেঙে পড়ায় প্রায় দেড়শাে বছর আগে কাশী থেকে পাথর ও মিস্ত্রি আনিয়ে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের গণ্ডি অংশে অসংখ্য অঙ্গশিখর যুক্ত করে মন্দিরের আভিজাত্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।  


তবে মন্দিরটির চারদিকে এতো ঘিঞ্জি বাড়িঘর রয়েছে, যার জন্য খুব খেয়াল না করলে মন্দিরটা চোখে পরে না। মন্দিরের দরজাটা বিশেষভাবে নজর কাড়ে। দেবদেবীর মূর্তি খােদাই করা, পিতলের পাতযুক্ত বিরাট কাঠের দরজাটির দেখলে, তৎক্ষণাৎ কালীঘাটের কালী মন্দিরের রূপাের পাতমােড়া দরজার কথা মনে পরে। দরজার দুটি পাল্লায় বসানো আছে চব্বিশটি পিতলের পাতে 'রাপুসে' পদ্ধতিতে খোদাই করা দশাবতার ও দশমহাবিদ্যার মুর্তি। তবে দশাবতারের বুদ্ধ ও বলরামের বদলে আছে গদ্ধমাদন হাতে হনুমান ও কংসবধের দৃশ্য। এছাড়াও আছে রাম-রাবণের যুদ্ধ, চন্দ্র, সূর্য ও গরুড় প্রভৃতির মূর্তি।


পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় পিতলের রথে যে ধরনের 'রাপুসে' খােদাইকাজ দেখা যায়, এখানের এই নকশাগুলি তারই সমগোত্রীয়। সুতরাং এখানকার এই খােদাই কাজের নিদর্শন দেখে মনে হয়, এগুলি উনিশ শতকের গােড়ার দিকে স্থানীয় কর্মকার বা কাঁসারি শিল্পীদের দ্বারা নির্মিত।


মূল দরজা দিয়ে ঢোকার পরেই আছে কড়ি-বরগার ছাদযুক্ত এক সুবিস্তৃত চাতাল, যা বর্তমানে নাটমন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এখানের উত্তর-পূর্ব কোণে দেওয়ালের গায়ে স্থাপিত গণেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হনুমানের মূর্তি। এই নাটমন্দির লাগোয়া পশ্চিমে এক উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর একদুয়ারি পূর্বমুখী মূল মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে বেশ খানিকটা অংশ সামনের দালান হিসাবে ব্যবহৃত, যা বাংলা ১৩৬১ সালে মোজাইক করে দিয়েছেন বিখ্যাত শাড়ি ব্যবসায়ী রামকানাই যামিনীরঞ্জন পাল। 


গর্ভগৃহের দু'পাশে দ্বারপাল হিসাবে রয়েছে জয় ও বিজয়ের পাথরের প্রতিমূর্তি। মন্দিরে মূল বিগ্রহ হল নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা, যা এক উঁচু বেদীর উপর স্থাপিত। বেদীর এক ধাপ নীচে রয়েছে কৃষ্ণরাধিকার মূর্তি।


পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণদেবও এই মন্দিরে পদার্পণ করেছেন। তিনি তাঁর পরমভক্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেনের বাড়িতে যাবার পথে, জগন্নাথ ঘাটে নৌকো থেকে নেমে এই মন্দির দর্শন করেছিলেন। বর্তমানে মন্দিরে ভিড় হয় ঠিকই, তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হলো, বেশি ভিড় হয় গণেশমূর্তি ও হনুমানমূর্তিতে পূজা দিতে। 

আরেকটা মজার কথা হলো, অঞ্চলে অনেকগুলো জগন্নাথ মন্দির গড়ে উঠেছে, তাই খুব ভালো করে না চিনলে, আপনি বুঝতে পারবেন না আসল শোভারাম বসাকের মন্দির কোনটা! এভাবেই সময়ের প্রবাহে ইতিহাসের একটা অধ্যায় বুকে নিয়ে চলমান রয়েছে একটা ঘাট ও একটা পুরোনো মন্দির।

তথ্যসূত্র:
১.  'কলিকাতার ইতিবৃত্ত' - প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।
২. কলিকাতাস্থ তত্ত্বণিক জাতির ইতিহাস' - নগেন্দ্রনাথ শেঠ।
৩. 'Ancient Monuments in Bengal' - Pandit Harimohan Bidyabhushan.
৪. কলকাতার উপাসনালয়, প্রথম খন্ড - পীযূষকান্তি রায়।
৫. কলকাতার মন্দির-মসজিদ : স্থাপত্য-অলংকরণ-রূপান্তর, তারাপদ সাঁতরা।
৬. লীলামৃত' - বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল।

Comments

  1. খুব সুন্দর।আজ দেখে এলাম

    ReplyDelete
  2. মন্দিরটি দেখেছি... এই বিগ্রহ ও আমার খুব ভালো লাগে

    ReplyDelete
  3. Informative

    ReplyDelete
  4. মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।কত পড়াশুনো করে, ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

    ReplyDelete
  5. বর্তমান মন্দির কমিটি যে শােভারাম দ্বারা জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বেমালুম অস্বীকার করছে এবিষয়ে উনার দ্বারা দেবত্ব সম্পত্তির নথিপত্রই কি যথেষ্ট প্রমাণ না? এছাড়া মন্দিরের নাম যখন শোভারাম বাবুর নামে সেখানে তার কাজকে এভাবে অস্বীকার করছে যেনে খারাপ লাগছে। আপনার প্রতিবেদন্টা পড়ে অনেক কিছু জানলাম।

    ReplyDelete
  6. এটা একদিন গিয়ে দেখে আসতে হয়। এই রকম আরো নতুন তথ্য দিতে থাকুক আমাদের KNK।

    ReplyDelete
  7. খুব সুন্দর -অসাধারণ

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)