নতুন কোলকাতার পুরোনো ভুতেদের গল্প (Story of the Old Ghosts of New Calcutta)
ভূত মানে তো অতীত! এই অতীতের স্মৃতি কখনো আমাদের সুখ দেয়, কখনো কষ্টও দেয়। আবার সে কখনো ভয়াল স্মৃতিকে টেনে নিয়ে আসে বর্তমানে... যা শুনলে আমাদের গা ছম-ছম করে ওঠে! রাজশেখর বসু তো এই প্রসঙ্গে বলেই গেছেন -
"এই কলকাতা শহরে রাস্তায় যারা চলাফেরা করে- কেউ কেরানি, কেউ দোকানি, কেউ মজুর, আর কেউবা অন্য কিছু। তা মোটেই নয়। তাদের মধ্যে সর্বদাই দু-চারটে ভূত পাওয়া যায়। তবে চিনতে পারা দুষ্কর।"
যেকোনো পুরোনো জিনিসের সাথেই মিশে থাকে কিছু গল্প। আমাদের কল্লোলিনী কোলকাতা অনেক আধুনিক হয়ে উঠলেও, তা বহন করে চলেছে অনেক পুরোনো স্মৃতি। আর সেই স্মৃতির অতলেই রয়েছে কোলকাতার কিছু পুরোনো ভুতুড়ে জায়গার গল্প।
কোলকাতার ভুতুড়ে জায়গার গল্প বলতে হলে শুরু করা উচিত একদম খাস ভুতেদের ডেরা থেকে, যা হলো কবরস্থান! কোলকাতায় কবরস্থানের অভাব নেই! এর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-গ্রিক-ইহুদি-আর্মেনিয়ান-চিনে সবই আছে।
আমি শুরু করবো সাউথ পার্ক সেমেটারি থেকে। এই কবরখানাটি আছে পার্কস্ট্রিটের শেষপ্রান্তে, মল্লিকবাজার ক্রসিংয়ের কাছে। ইংরেজি ১৭৬৭ সালের এটি খোলা হয়, এবং কবর দেওয়া হয় ১৭৯০ সাল পর্যন্ত। শহরের একটা প্রাচীন চার্চহীন কবরখানা এটি। বর্তমানে এটি একটি হেরিটেজ সাইট হওয়া সত্ত্বেও, কোলকাতার বিখ্যাত ভৌতিক জায়গাগুলোর মধ্যে এটি একটি। অধিকাংশই বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ও তাদের পরিবারের কবর আছে এখানে। উঁচু স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালে ঘেরা, গাছপালায় ঢাকা আবছা অন্ধকার এই কবরখানা। শোনা যায়, রাত হলেই জেগে ওঠে এখানকার কবরের অধিবাসীরা। এর জন্য আশেপাশের বেশিরভাগ বাড়ির জানালাগুলো বন্ধ থাকে রাতে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের "গোরস্থানে সাবধান" সিনেমার শুটিংয়ের সময় অনেক ঘটনা ঘটেছিল এখানে, যার কোনো ব্যাখ্যা জাগতিক বুদ্ধিতে ঘটে না। এছাড়াও এখানে স্পিরিট ফটোগ্রাফি সফল হয়েছে বেশ কয়েকবার। আর এখানে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের অনেকেই এখানে এলে অসুস্থ হয়ে পড়েন, আবার গেটের বাইরে এলেই সুস্থ! অনেকে বিভিন্ন ছায়ামূর্তিও দেখেছেন এখানে, আমিও এখানে অশরীরীদের উপস্থিতি টের পেয়েছি।
রাস্তার ওধারেই রয়েছে লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটারি। ১৮৪০ সালে তৈরী এই কবরখানাতে এখনো কবর দেওয়া হয়। এখানে প্রচুর বৃটিশ কর্মচারীদের সাথে, কিছু বিখ্যাত লোকজনেরও কবর রয়েছে। ছোট ছোট কিছু ভুতুড়ে ঘটনা ঘটলেও, এখানে সবথেকে বেশি ভয়াবহ ঘটনা সিভিল সার্ভেন্ট স্যার উইলিয়াম হে ম্যাকনটনের কবরে। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে তিনি নিহত হন, এবং তার দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে ছড়িয়ে ফেলে শত্রুপক্ষ। ওনার স্ত্রী বহু কষ্ট করে এই শরীরের অংশগুলো একসাথে জোগাড় করে নিয়ে এসে, তা কবর দেন এই কবরখানাতে। এরপর থেকে শোনা যায়, এই কবরটির সামনে গেলে, বা এই ঘটনা বিবৃত করলে... কবরের লাগোয়া গাছটি থর-থর করে কাঁপতে থাকে!
আজকের নতুন চায়নাটাউন যেখানে, অর্থাৎ ট্যাংরা ও তপসিয়া অঞ্চলে রয়েছে চিনেদের কয়েকটি কবরখানা। এখানে লোকজন খুব বেশি যান না। কবরখানাগুলো ছোট ছোট, আর বেশ নির্জন। এখানের বাতাস খুব ভারী, আর সবসময় মনে হবে যে আপনি একলা উপস্থিত নন। আমার নিজের ও পরিচিত কয়েকজনের নানান ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানে।
হিন্দুদেরও রয়েছে কিন্তু একটা কবরখানা! শুনলে অবাক হবেন, কিন্তু এরকম একটা কবরখানা রয়েছে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে, যদিও এটা সেরকম একটা প্রাচীন নয়। বাসস্টপের নাম গোবরা। যেসব সদ্যোজাত বা ছোট হিন্দু বাচ্চারা মারা যায়, তাদের কবর দেওয়া হয় এখানে। এছাড়া কিছু বৈষ্ণব গুরুদের কবর আছে এখানে। খুব অদ্ভুতভাবে, এখানে গেলে আপনার মন ভারাক্রান্ত হবেই। আর অনেকেই এখানে বাচ্চাদের কান্না, আবার খোল করতালের আওয়াজও শুনেছেন।
একটা হারিয়ে যাওয়া কবরখানার আর হাসপাতালের জমির উপরে গড়ে উঠেছিল একটা পুরোনো বাড়ি, যাতে ছিল আকাশবানীর পুরোনো অফিস। সেই অফিসে কর্মরত অনেকেই সাহেবদের ভুত দেখেছেন, ঘটতে দেখেছেন অনেক অলৌকিক কার্যকলাপ। অঞ্চলটা হলো গারস্টিন প্লেস, যার ১ নম্বর ঠিকানাতেই ছিল পুরোনো আকাশবাণীর অফিস।
কোলকাতার ভৌতিক শ্মশানের কথা বলতে হলে মনে আসবে নিমতলা মহাশ্মশানের কথা। এখানে রয়েছে বিখ্যাত ভূতনাথের মন্দির, এবং রবীন্দ্রনাথের সমাধি। অমাবস্যার রাতে এখানে এসে সাধনা করেন অঘোরী সন্ন্যাসীরা। এছাড়াও এখানকার প্রহরীরা বহুবার অনেক আত্মাদের ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন এখানে।
নিমতলার শ্মশানের থেকে, গঙ্গার ধার দিয়ে চলুন এগিয়ে যাওয়া যাক শোভাবাজার জেটির দিকে। কাছেই আছে কোলকাতার এক বিখ্যাত ভুতুড়ে বাড়ি, যার পরিচিতি হলো "পুতুলবাড়ি" নামে। এখানে বর্তমানে কিছু লোক বসবাস করেন একতলায়। বাড়িটির গাত্র-অলঙ্করণ খুবই সুন্দর ছিল বানানোর সময়, যার চিহ্ন এখনো দেখা যায়। একসময় এই বাড়িতে অনেক দাস-দাসীসহ বাস করতেন এক বড়লোক বাঙালি মনিব (যাদের 'বাবু' বলা হতো)। মনিবটি ছিলেন বিকৃত-যৌনতায় অভ্যস্ত, তাই বাড়ির অনেক দাসীদের সাথে জোর করে তিনি নিজের লালসা মেটাতেন ও তাদের হত্যা করে বাড়ির পিছনে লাশ মাটিচাপা দিতেন। কিন্তু আজও সেই মেয়েদের আত্মারা রাতের বেলা কেঁদে বেড়ায় এই বাড়িতে।
শ্মশানের কথাই যখন এলো, তখন সেই শ্মশানের অস্থি যেখানে বিসর্জন দেওয়া হয়, সেই গঙ্গার ঘাটের প্রসঙ্গ উঠে আসে। কতো শত বছর ধরে মানুষ জলে ডুবে মারা যাচ্ছে... তাদের আত্মার কথা। আজকে যেখানে হাওড়া ব্রিজের নীচে মল্লিকঘাট ফুলের বাজার, তার লাগোয়া ঘাটগুলো... যেমন ছোটেলালের ঘাট, রামচন্দ্র গোয়েঙ্কার ঘাট, মল্লিকঘাট এসব জায়গায় খুব ভোরবেলা যারা গেছে, তারা অনেকেই দেখেছে এক সর্বাঙ্গে সাদা কাপড় জড়ানো মহিলাকে, যে হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং নাকিসুরে ডাকছে লোকজনদের! কিন্তু কেউ এগিয়ে গেলে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারথেকেও ভয়াবহ হলো, নদীবক্ষে দেখা যায় জলের ভিতর থেকে হাত উঠে আসছে, যেন কোনো ডুবন্ত মানুষ বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা করছে। কিন্তু ওই হাতের অধিকারী বা অধিকারিণীকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে, সে টেনে নিয়ে যাবে নদীর গভীরে, ত্রাণকর্তার ঘটবে সলিলসমাধি! আসলে নদীতে যারা দুর্ঘটনায় মারা গেছে, তাদের অতৃপ্ত আত্মাদের কার্যকলাপ এগুলো, আর হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার সংখ্যাটাও নেহাত কিছু কম না!
নদীর কথাই যখন উঠলো, তখন কোলকাতার নদীবন্দর অঞ্চলই বা বাদ যায় কেন! দেখতে দেখতে ১৫০ বছর হয়ে গেল বৃটিশদের তৈরি, ভারতের এই প্রাচীন বন্দরের। এই অঞ্চলেই স্বজন-বন্ধু সহ নির্বাসিত হয়েছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহ। এখনো রাতের ডিউটিতে যারা এখানে কাজ করেন, তারা বহু অলৌকিক ঘটনা দেখেছেন। একজন ক্রেন অপারেটর দেখেছেন নবাবী যুদ্ধসাজে সজ্জিত এক মুন্ডহীন ধড়কে ঘুরে বেড়াতে, কেউ বা দেখেছেন অন্ধকার গুদামঘর অঞ্চলে হটাৎ আলোকিত হয়ে ভুতেদের অলৌকিক কার্যকলাপ। অদূরেই জোর করে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল মহারাজ নন্দকুমারকে, তার নিঃশ্বাসেও ভারী হয়ে আছে এই অঞ্চল।
মুন্ডহীন ধড়ের প্রসঙ্গে মনে পড়লো, একটা সময়ে শেষ রাতের দিকে মাজেরহাট ব্রিজের নীচে নাকি দেখা যেত এক স্কন্ধকাটাকে, যার সামনে পড়লে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না! জানিনা এখনো সেই স্কন্ধকাটা আছে কিনা।
নবাবের কথা যখন এলো, সেই প্রসঙ্গে উঠে আসে ঘোড়ার কথা। আচ্ছা, কোলকাতার ময়দানের একপাশে আছে বৃটিশদের সময়ে তৈরি The Royal Calcutta Turf Club, যাকে আমরা সাধারণভাবে বলে থাকি রেসকোর্স। মূলত শনিবারের জোছনায় ভেজা রাতে, এখানের রেসট্র্যাকে ছুটতে দেখা যায় একটি দুধসাদা ঘোড়াকে। ছুটতে ছুটতে সে মিলিয়ে যায় হাওয়াতে। এই ঘটনার পিছনে আছে এক করুণ কাহিনী। এই ঘোড়াটির নাম ছিল প্রাইড, যার মালিক ছিলেন মিস্টার জর্জ উইলিয়াম। কোনো রেসে কোনোদিন হারেনি প্রাইড। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে বৃদ্ধ হয়, এবং জীবনে অন্তিম রেসে হেরে যায় এই রেসট্র্যাকেই। এর পরের দিন, প্রাইডকে ঘাড় গুঁজে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এখানে। উইলিয়াম সাহেবও তার ঘোড়ার শোকে বেশিদিন আর বাঁচেন নি।
এই রেসকোর্সের পাশেই গভীর রাতের দিকে মাঝে মধ্যে দেখা যায় এক উর্দিপড়া ট্রাফিক সার্জেন্টকে। চলতি ট্যাক্সি থামিয়ে তিনি উঠে পড়েন। গাড়ি কিছুটা চলার পরে, চালক যখন লুকিং গ্লাসে দেখেন পিছনের সিট খালি, তখন তিনি শিউরে ওঠেন!
ঘোড়ার কথা যখন উঠলো, তখন ঘোড়ার গাড়িই বা বাদ যায় কেন! কোলকাতার এক পুরোনো বাড়িতে এখনো গভীর রাতে এসে দাঁড়ায় চারটি ঘোড়ায় টানা এক জুড়িগাড়ি, সেখান থেকে এক সাহেব তাড়াহুড়ো করে নেমে ছুটে বেড়ায় পুরো বাড়ি জুড়ে, খুঁজতে থাকে তার হারানো একটি কালো কাঠের বাক্স। কেউ তাকে দেখতে পায়, আবার কেউ তার পায়ের শব্দ শুনতে পায়। এই সাহেবটি হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, আর বাড়িটি হলো হেস্টিংস হাউস। এছাড়া এখানে ফুটবল খেলতে খেলতে বুকে বল লেগে মারা গিয়েছিল একটি ছেলে... যে আজও খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধুদের অপেক্ষায়। একটি গুলিতে মৃত ঘোড়াকেও দেখা যায় এখানে।
বৃটিশ বড়োকর্তাদের কথাই যখন এলো, তখন তাদের ব্যবহৃত বাড়িগুলোর উল্লেখ্য করে দেওয়া যাক! আচ্ছা, কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোলকাতার প্রাচীনতম বাড়ি কোনটা... সেই প্রশ্নের উত্তর সত্যি দেওয়া কঠিন। তবে এরকম একটা প্রাচীন বাড়ি হলো ক্লাইভ হাউস। লর্ড ক্লাইভ যখন প্রথম কোলকাতায় আসেন, দমদম নাগেরবাজারের কাছে অবস্থিত এই পুরোনো বাড়িটি তিনি দেখেন ও সেখানে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু এই বাড়িটি যে কে বানিয়েছিল, সেটা আজও জানা যায় নি। এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে অনেক পুরোনো জিনিস ও মানুষের হাড়-গোড় পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাড়িটি প্রায় ভেঙে পড়েছে, তাই ভিতরে যাওয়া বারণ। কিছু অলৌকিক ঘটনা দেখা গেছে এখানে, আর আমারও নিজের সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের মুখে একটা কিংবদন্তি আছে, সেটা হলো এই বাড়ি নাকি এক রাতের মধ্যে তৈরী হয়েছিল, এবং সেটা মানুষের তৈরি নয়। যারা তৈরি করেছিল, তারা কোনোদিনও মনুষ্যযোনির ছিল না।
এর পরেই বলতে হয় পুরোনো কোলকাতার গভর্নর জেনারেলদের বাড়ি, অধুনা ন্যাশনাল লাইব্রেরীর কথা। এখানে তো একটা ভুতুড়ে পালকির আনাগোনা দেখা যায়ই, যার সাথে জড়িয়ে আছে একটা ত্রিকোণ প্রেম আর ডুয়েলের গল্প। এছাড়াও বিভিন্ন আত্মার আনাগোনা আছে এর আনাচে কানাচে। তবে সবথেকে বেশি যে গল্পটা প্রচলিত, সেটা হলো লর্ড মেটাকাফের স্ত্রীর আত্মার। লেডি মেটাকাফে ছিলেন খুবই পরিচ্ছন্নতাপ্রিয় মহিলা। কেউ লাইব্রেরীর বই ঘেঁটে বা ছড়িয়ে রাখলে, তিনি খুব বিরক্ত হন। অনেক নাইট গার্ড ও লাইব্রেরীর সদস্যরাই শুনেছেন তার পদশব্দ।
এবার ফিরে আসা যাক আমাদের ডালহৌসি এলাকাতে। আজকে যেখানে জেনারেল পোস্ট অফিস (জি.পি.ও.) দাঁড়িয়ে আছে, মোটামুটি সেখানেই ছিল কোলকাতার পুরোনো ফোর্ট উইলিয়াম। আজও যারা এখানে নাইট ডিউটি করেন, তারা শুনতে পান ঘোড়ার ডাক, অনুভব করতে পারেন ছায়ামূর্তির আনাগোনা।
এবার এগিয়ে আসি এক বিখ্যাত বাড়ির দিকে, যার নাম রাইটার্স বিল্ডিং। প্রথম দিকে এই বাড়ি বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কেরানীদের থাকার কাজে ব্যবহৃত হলেও, পরবর্তীকালে এটি বৃটিশদের প্রশাসনিক ভবনে পরিণত হয়। এখানেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়-বাদল-দিনেশ, কোলকাতা পুলিশের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে ১৯৩০ সালে হত্যা করেন। শোনা যায়, এই সিম্পসন ছিলেন ভীষণভাবে স্বদেশী বিরোধী, এবং নানান নতুন ধরণের কৌশলে তিনি বিপ্লবীদের অত্যাচার করতেন। তার অতৃপ্ত আত্মা এখনো রাতে দাপিয়ে বেড়ায় এই বাড়ি। এছাড়াও আরো অলৌকিক কার্যকলাপ দেখেছে এই বাড়ির রাতের রক্ষীরা।
এই বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই আছে লালবাজার, কোলকাতার পুলিশের হেডকোয়াটার্স। এই লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে নাকি ভুত দেখা যায়। এর পিছনে আছে নকশাল আমলের একটা ঘটনা। ১৯৭২ সালের ২৮শে জুলাই লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় তৎকালীন নকশাল নেতা চারু মজুমদারের। তারপর থেকেই, বহুবার লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপের আশেপাশে দেখা যায় চারুবাবুর অশরীরী ছায়ামূর্তিকে। দেখা দিয়ে মিলিয়ে যান তিনি, আবার কখনো শোনা যায় আর্তচিৎকার। তাই রাত বাড়লে কেউ পারতপক্ষে ঘেঁষতে চাননা ওদিকে।
এবার চৌরঙ্গী রোড দিয়ে এগোনো যাক পার্ক স্ট্রিটের দিকে। একটু এগিয়ে বামদিকে ঢুকে পড়লে, চোখে পড়বে লাল রঙের কোলকাতার কর্পোরেশন বিল্ডিং। ঊনবিংশ শতকের এই বাড়িটিও ভৌতিকতায় কম যায় না। গভীর রাতের থমথমে পরিবেশে এখনো এখানে শোনা যায় মহিলাকণ্ঠের কান্না, সাথে শোনা যায় বিচিত্র নানান আওয়াজ।
আরেকটু এগোলে বামদিকে রাস্তার উপর পড়বে একটা প্রকান্ড সাদা বাড়ি, যার নাম ভারতীয় জাদুঘর। এখানে রয়েছে মিশর থেকে আনা মমি, যাকে ঘিরে আছে অনেক রহস্য। বারান্দায় গভীর রাতে শোনা যায় নুপুরের ধ্বনি। দেখা যায়, এক শ্রমিক সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে... বহুকাল আগেই যার মৃত্যু হয়েছিল স্কাইলাইট পরিষ্কারের সময়, দুটো ভারী শোকেসের মাঝে চাপা পড়ে। মুখোশের গ্যালারিতে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়, অনেকেই অনুভব করছেন অদৃশ্য কেউ পাশ কাটিয়ে চলে গেল! আর মিউজিয়ামের আশুতোষ হলে, রাতের বেলায় কোনো এক অশরীরী রোজ গেট দিয়ে ঢুকে হলঘরে চলে যান। কোনো প্রহরী যদি সেই রাস্তায় শুয়ে থাকেন, তবে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন সেই আত্মা!
মিউজিয়ামের লাগোয়া রয়েছে সদর স্ট্রিট, যেখানে বহু বছর আগে থাকতেন মিস্টার স্পিক নামের এক সাহেব। তার কাছে কোনো একটা আর্জি নিয়ে এসেছিলেন এক শিখ যুবক। কিন্তু বচসা বাঁধে সেটা নিয়ে সাহেবের সাথে। এই সদর স্ট্রিটেই তিনি তৎক্ষণাৎ চড়াও হন সাহেবের উপরে, এবং সম্ভবত সাহেব বা তার কোনো রক্ষীর গুলিতে নিহত হয়ে, লুটিয়ে পড়েন এই রাস্তাতেই। এখনো নাকি গভীর রাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় এখানে। কিন্তু কেউ সাহস করে দেখতে গেলে, হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সবকিছু।
এছাড়াও সারা কোলকাতা জুড়েই ছড়িয়ে আছে অনেক পুরোনো বাড়ি, যা ওতো বিখ্যাত না হলেও অশরীরীদের আনাগোনা আছে সেখানে। বহু পুরোনো বাড়ি পড়েছে প্রমোটারির কবলে, ভেঙে নতুন বাড়ি বা ফ্লাট গজিয়ে উঠছে... হারিয়ে যাচ্ছে কতো গল্প আর কিংবদন্তি। আবার নতুন নতুন বাড়ি বা অঞ্চলে শুরু হচ্ছে সেই অশরীরীদের আনাগোনা। হয়তো এভাবেই তারা নেবে নিজেদের বাসস্থান কেড়ে নেবার প্রতিশোধ, যেমন দেখানো হয়েছিল অনিক দত্তের "ভুতের ভবিষ্যৎ" ছায়াছবিটিতে...
"শেষ পর্যন্ত ভুতেরা ঘুরে দাঁড়ালো। চৌধুরী বাড়িতে সৃষ্টি হলো এক নতুন ইতিহাস। পড়ে পড়ে মার খাওয়া ভুতেদের, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস।"
তথ্যসহায়তা: পলাশ কর্মকার; ঈশানি ঘটক; প্রদীপ সোনথালিয়া; নিমতলা শ্মশান অঞ্চলের রক্ষীরা; রাতের দিকে রেসকোর্স অঞ্চলে গাড়ি চালানো কয়েকজন ট্যাক্সিচালক।
তথ্যসূত্র:
১) traveltriangle.com/blog/haunted-places-in-kolkata/amp/
২) fabhotels.com/blog/haunted-places-in-kolkata/amp/
৩) nomadicweekends.com/blog/haunted-places-in-kolkata/
৪) debipakshalive.com/10-most-haunted-places-kolkata.php/amp
৬) bangla.asianetnews.com/amp/kolkata/haunted-places-in-kolkata-pzvznh
৯) ভূতের ভবিষ্যৎ : পরিচালক অনিক দত্ত
১০) পুরোনো কলকাতার ভুতুড়ে বাড়ি : লেখক সুভাষ সমাজদার
Puro Kolkata r sob bhoutik place gulo k eksonge kore darun likhecho, Khub bhalo laglo
ReplyDeleteকলকাতার প্রাচীন ও বর্তমান ভূত, তাঁদের অবস্হান, পেশা ও নৈমিত্তিক কার্যাবলীর ওপর এমন প্রামাণিক গবেষণা খুব কম পাওয়া যায়। লেখককে অনেক অঁশরীরি অঁভিনঁন্দন জাঁনাই।
ReplyDelete