বিশ্বজুড়ে মোরগ লড়াই: এক পুরানো, বিতর্কিত খেলা (Cockfighting Across the World: An Ancient, Controversial Sport)

সেদিন ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছিল হাওড়া হয়ে, গন্তব্য খড়গপুরের চৌরঙ্গী মোড়। পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢুকে, একটা ছোট ব্রেক নেবার জন্য সবাই নামলাম বসন্তপুরের একটা ছোট চায়ের দোকানে। হাইওয়ের যে দিকে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, তার উল্টোদিকে একটা ছোট মাঠের মধ্যে গাছের তলায় দেখলাম বেশ ভিড় জমেছে, যেন কোনো গ্রাম্য হাট বসেছে। আমাদের গাড়িচালক-দাদাকে জিজ্ঞাসা করতেই শুনলাম ওখানে নাকি মোরগ লড়াই চলছে! 

বাংলার রাঢ়বঙ্গ অঞ্চলের খুব জনপ্রিয় খেলা হলো এই মোরগ লড়াই। মানব ইতিহাসে বহু পুরনো এবং পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে এর চল ছিল।

এই খেলাটি প্রথমে ভারত, চীন, পারস্য এবং আশেপাশের পূর্বের দেশগুলিতে শুরু হলেও, পশ্চিমে এর পরিচিত হয় প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৫২৪-৪৬০ সালের দিকে, গ্রিক সেনাপতি থেমিস্টোক্লিসের হাত ধরে। এরপর এটি এশিয়া মাইনর (তুরস্ক) এবং সিসিলি হয়ে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তুরস্কের জাতীয় খেলা বর্তমানে এই মোরগ লড়াই!

 

রোমানরা প্রথমে এই খেলাটিকে পছন্দ করত না। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা এই খেলায় এতটাই মত্ত হয় যায়, যে তারা মোরগ লড়াইয়ের মাঠে বাজি ধরে তাদের সব সম্পত্তি নষ্ট করত! রোম থেকে এটি ইতালি, জার্মানি, স্পেন, এবং ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা ও কিছু কর্তৃপক্ষ এর বিরোধিতা করলেও, ষোড়শ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এটি ইংরেজ রাজা ও অভিজাতদের খুব পছন্দের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

যারা মোরগ লড়াই পছন্দ করে, তারা এটিকে পেশাদার খেলার চেয়ে শখের খেলা বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তবে এর আসল আকর্ষণ হলো জুয়া খেলা। কোন মোরগ জিতবে—এই নিয়ে প্রচুর টাকার বাজি ধরা হয়। 

মোরগ লড়াইয়ের বিবরণ দেবার আগে, লড়াইয়ের প্রাঙ্গণ এবং তার আশেপাশের একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। মাঠের একটা ধারে রয়েছে লড়াইয়ের আঙিনা, যেটা ছোট উচ্চতার কাঠি দিয়ে তার মধ্যে দড়ি লাগিয়ে বানানো হয়েছে। রয়েছে সূঁচ সুতো ব্যান্ডেজ আর ওষুদ নিয়ে মোরগের চিকিৎসক। আর রিফ্রেশমেন্ট হিসেবে রয়েছে সিগারেট, বিড়ি এবং স্থানীয় মদ 'হাড়িয়া', যেটা একটা বড়ো গামলায় রেখে খবরের কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, এবং ছোট ছোট স্টিলের বাটিতে খদ্দেরদের দেওয়া হচ্ছে! তারাও একহাতে হাড়িয়ার বাটি আর অন্যহাতে ছোলাসেদ্ধ নিয়ে তৃপ্তির চুমুক দিচ্ছে!

এবার আসি লড়াইয়ের বিবরণে। মোরগ লড়াইয়ের এই আসরগুলি মূলত গ্রামীণ জনজীবনের উৎসবের দিনগুলিতে, বিশেষত সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে অথবা বিশাল হাট বা মেলার সমাপ্তিতে খোলা মাঠে বসে। অনেক সময় এটি নিয়মিত প্রতিযোগিতার রূপও নেয়।

প্রতিযোগিতায় ব্যবহারের মোরগদের বলা হয় 'ষাঁড়া'। এই খেলায় যেসব মানুষেরা তাদের 'ষাঁড়া' নিয়ে অংশগ্রহণ করেন, তাদের পরিচয় হল "হাঁউসি"। খেলার মাঠে এসে এই "হাঁউসি"-রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বা পছন্দ অনুযায়ী প্রতিপক্ষ স্থির করেন। তবে যদি এটি কোনো সংগঠিত প্রতিযোগিতা হয়, তবে প্রতিপক্ষ নির্বাচনের দায়িত্ব থাকে আয়োজক মণ্ডলীর ওপর।

প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিক হয়ে গেলে, অংশগ্রহণকারীরা তাদের মোরগ নিয়ে যান "কৌতকি" বা রিং মাস্টারের কাছে। এই "কৌতকি"-রাই মূলত মোরগদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেন। প্রথা অনুযায়ী, মোরগের বাম পায়ে একটি লাল সুতো দিয়ে শক্ত করে ছোট ও ধারালো একটি অস্ত্র বা ছুরি বেঁধে দেওয়া হয়। এই অস্ত্রটিকে "কাঁত" বলা হয়। প্রয়োজন অনুসারে এই "কাঁত" ভাড়া দেওয়া এবং শান দেওয়ার জন্য কামারেরা হাজির থাকেন এখানে।

লড়াইয়ের মূল পর্ব শুরু হলে দুটি মোরগ একে অপরের ওপর মরণপণ আক্রমণ চালায়। এই দ্বৈরথ চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি মোরগ আহত হয়ে রণে ভঙ্গ দেয়, পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নামিয়ে ফেলে, অথবা আঘাতের কারণে প্রাণ হারায়।

এই খেলার একটি অলিখিত শর্ত হলো, জয়ী "হাঁউসি" বিজিত "হাঁউসি"-র মোরগটির (সেটি জীবিত বা মৃত যাই হোক) দাবিদার হয়ে যান। লড়াই পরিচালনার জন্য "কৌতকি"-রা জয়ী "হাঁউসি"-র কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন। যদি পরাজিত মোরগটি বেঁচে থাকে, তবে তাঁরা নগদ অর্থ নেন। তবে যদি মোরগটি মারা যায়, তবে তার দাবনাসহ একটি পা "কৌতকি"-র প্রাপ্য বলে বিবেচিত হয়। সাধারণত এই খেলায় কোনো নগদ পুরস্কারের চল নেই, একমাত্র কোনো বিশেষ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিজয়ীরা অর্থ পুরস্কার লাভ করেন।

উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করলেও, মোরগ লড়াই ধীরে ধীরে আইনি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। এই কঠোর পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল ১৮৩৬ সালে ম্যাসাচুসেটস-এ পশু নিষ্ঠুরতা বিরোধী আইন পাসের মাধ্যমে। এর কিছু পরেই, ১৮৪৯ সালে গ্রেট ব্রিটেন আইন করে এই খেলাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে, কানাডা এবং বেশিরভাগ মার্কিন রাজ্যে এটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ খেলা হিসেবে গণ্য।

এই আইনি পদক্ষেপগুলি এই খেলাটিকে একটি পাবলিক খেলা হিসেবে বন্ধ করতে সফল হলেও, এটি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়নি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের মতো জায়গায় মোরগ লড়াই গোপনে টিকে ছিল।

অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকায় এর অবস্থান ছিল ভিন্ন: কিউবায়, ১৯৫৯ সালের কাস্ত্রো শাসনামলে সরকারই এই খেলাকে নিয়ন্ত্রণ করত, যা নিষেধাজ্ঞার বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। তবে, প্যারাগুয়ের মতো অন্যান্য দেশও এটিকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

সবশেষে বলা যায়, মোরগ লড়াই একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জুয়ার ক্ষেত্র হিসেবে চলে আসছে, তেমনি অন্যদিকে এটি বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হচ্ছে। আইন ও নৈতিকতার দিক থেকে, খেলাটির গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমছে।

(English Version)

Cockfighting Across the World: An Ancient, Controversial Sport

The car was speeding along the National Highway that day, passing through Howrah, with our destination being Chowringhee More in Kharagpur. Upon entering Paschim Medinipur district, we all stopped for a brief break at a small tea stall in Basantapur. Across the highway from where we were standing, we noticed a sizable crowd gathered under a tree in a small field, resembling a village fair. When we asked our driver, he told us that a cockfight was underway there!

Cockfighting is an extremely popular game in the Rarh Bengal region of West Bengal. It is ancient in human history and has been practiced in many parts of the world.

Though this sport originated in India, China, Persia, and the surrounding Eastern countries, it was introduced to the West around 524–460 BCE by the Greek general Themistocles. It subsequently spread across Europe via Asia Minor (Turkey) and Sicily. Remarkably, cockfighting is currently the national sport of Turkey!

The Romans initially disliked the sport. However, they later became so captivated by it that they would wager and lose all their possessions at the cockfighting arenas! From Rome, it spread to Italy, Germany, Spain, and extended to England, Wales, and Scotland. Despite opposition from Christian religious leaders and some authorities, it remained a favorite pastime for English kings and the aristocracy from the 16th to the 19th centuries.

Those who enjoy cockfighting prefer to describe it as a hobby rather than a professional sport. However, its main attraction lies in gambling. Large sums of money are wagered on which rooster will emerge victorious.

Before describing the fight itself, let's detail the arena and its surroundings. On one side of the field is the fighting pit, which is constructed using short sticks with rope strung between them. Nearby is the 'rooster medic,' equipped with needle, thread, bandages, and medicine. For refreshments, there are cigarettes, bidis, and a local liquor called 'harh-ia,' which is kept in a large basin, covered with newspaper, and served to customers in small steel bowls! They contentedly take sips, holding the bowl of harh-ia in one hand and boiled chickpeas in the other!

Now, for the description of the fighting. These cockfighting events are usually held in open fields during festivals in rural life, specifically on certain days of the week, or at the conclusion of large markets or fairs. Sometimes, it also takes the form of a regular competition.

The roosters used in the competition are called "Shara." The people who participate in this sport with their 'Shara' are known as "Haunsi." Upon arriving at the field, these 'Haunsi' either discuss among themselves or choose an opponent based on preference. However, if it is an organized competition, the responsibility for selecting opponents lies with the organizing committee.

Once the opponents are decided, the participants take their roosters to the "Kautuki" or ringmaster. These 'Kautuki' are primarily responsible for preparing the roosters for the fight. Traditionally, a small, sharp weapon or knife is tightly secured to the rooster's left leg with a red thread. This weapon is called a "Kaant." Blacksmiths are present at the venue to rent out and sharpen these 'Kaant' as needed.

When the main bout begins, the two roosters launch a mortal attack on each other. This duel continues until one rooster is injured and abandons the fight, bows its head in defeat, or succumbs to its injuries.

An unwritten rule of this game is that the victorious 'Haunsi' becomes the claimant of the vanquished 'Haunsi's' rooster (whether dead or alive). The 'Kautuki' who manages the fight receives a fixed percentage of payment from the winning 'Haunsi.' If the defeated rooster is still alive, they take cash. However, if the rooster dies, one of its legs, including the spur, is considered the due of the 'Kautuki.' Generally, there is no system of cash prizes in this sport, though winners may receive monetary awards in special competitions.

While quickly gaining popularity in the North American colonies, cockfighting gradually faced legal prohibitions. This strict action began in 1836 with the passage of an anti-animal cruelty law in Massachusetts. Shortly thereafter, in 1849, Great Britain banned the sport entirely by law. Currently, it is explicitly considered a prohibited sport in Canada and most US states.

These legal measures successfully halted the sport as a public spectacle, but they did not eliminate it completely. Despite the bans, cockfighting secretly persisted in places like the United States, Canada, and the British Isles.

In Latin America, the situation was different: in Cuba, during the Castro regime in 1959, the government itself regulated the sport, presenting a contrast to prohibition. However, other countries like Paraguay also declared it legally forbidden.

In conclusion, while cockfighting continues to exist as both a cultural tradition and a gambling arena, it is simultaneously being criticized globally. From a legal and ethical standpoint, the sport's acceptance is diminishing day by day.