মহীশূর উদ্যান ও তার বিস্মৃত ইতিহাস (Mysore Garden and it's forgotten history)

কেওড়াতলা মহাশ্মশানের কাছে একটা খুব সুন্দর পাঁচিলঘেরা পার্ক আছে, যার গেটটা খুব কারুকার্যময়। পার্কের ভিতরে আছে খুব সুন্দর করে সাজানো বাগান আর একটা বড়ো বিষ্ণুমন্দির। লোকজন এখানে এখন প্রাতঃভ্রমণ করতে আসে। 


পার্কটার নাম মাইসোর গার্ডেন, বা মহীশূর উদ্যান। এর সাথে জড়িয়ে আছে মহীশূরের মহারাজ স্যার চামারাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার বাহাদুরের মৃত্যুর ঘটনা। কিন্ত সেটা বলার আগে চামারাজেন্দ্র সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। মহীশূরের ২৩তম মহারাজ চামারাজেন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৮৬৩ সালে। পিতার নাম সর্দার চিকা কৃষ্ণরাজ এবং মাতার নাম রাজকুমারী পুতাম্মানি দেবী, যিনি ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণরাজ ওয়াদিয়ার কন্যা। কিন্তু রাজার কোনো পুত্রসন্তান না থাকায়, চামারাজেন্দ্রকে তিনি দত্তক নেন ১৮ই জুন ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে। এই পদক্ষেপ বৃটিশদের অনুমতিসাপেক্ষেই হয়েছিল, কারণ ১৮৩১ সাল থেকেই মহীশূর ইংরেজ-শাসনাধীন ছিল। 


মহীশূরের রাজ্যভার চামারাজেন্দ্রর হাতে যায় ২৫শে মার্চ ১৮৮১ সালে। রাজা হিসেবে অনেক কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে নারী-শিক্ষার প্রসার, কারিগরী শিক্ষামূলক স্কুলের পত্তন, কৃষি-ব্যাংকের জন্য অর্থসাহায্য, রাজকর্মচারীদের জন্য জীবনবিমার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো-যাত্রার জন্য তিনি অর্থসাহায্য করেছিলেন, এবং ওনার বক্তৃতা তিনি ফোনোগ্রাফ নামের এক যন্ত্রে রেকর্ড করেছিলেন। 

১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজা চামারাজেন্দ্র কোলকাতায় আসেন লর্ড এলগিনের সাথে দেখা করার জন্য, উঠলেন লেডি অ্যানি মঙ্কের ১৩ নম্বর চৌরঙ্গী রোডের বিলাস বহুল এক হোটেলে, যার আজকের নাম গ্র্যান্ড হোটেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোলকাতাতেই ডিপথেরিয়া হয়ে, মাত্র সাত দিনের মধ্যে চামারাজেন্দ্রর মারা যান, ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে। 

এবার সমস্যা হলো রাজার মৃতদেহ কিভাবে নিয়ে যাওয়া হবে মহীশূর, কারণ সে তো অনেক দিনের রাস্তা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এখানেই রাজার শেষকৃত্য সম্পাদনা হবে। সেই জন্য রাতারাতি আদিগঙ্গার ধারে জমি কেনা হলো অনেকটা, আর সেখানে বানানো হলো রাজঘাট। সেই ঘাটের পাশের জমিতেই শেষকৃত্য হলো রাজার। কাজ হয়ে যাবার পরে, রাজপরিবারের নির্দেশে কর্ণাটকের বেলুড় হ্যালোবিদের মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হল কারুকার্যমন্ডিত এক বিষ্ণু মন্দির, এবং তার লাগোয়া জমিতে সুদৃশ্য বাগান। স্থপতি ছিলেন বার্ন এন্ড কোম্পানি। মন্দিরের শিখরে স্থাপন করা হলো এক স্বর্ণ-কলস।


এই মন্দির ও বাগানের খরচ বহন করতো মহীশূর রাজপরিবার। মহীশূরের রানী নিয়মিত আসতেন এখানে শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু আশির দশকে মাইসোর গার্ডেন চলে যায় রাজ্যসরকারের হাতে। গার্ডেনের অবহেলা শুরু হয়, এবং তা হয়ে ওঠে নেশাখোর ও সমাজবিরোধীদের আখড়া। স্বর্ণকলসটিও চুরি হয়ে যায় এর মধ্যে। পুনরায় ১৯৯৫ সালে এই বাগানের যত্ন করা শুরু করে পুরসভা, এবং আবার সেজে ওঠে মাইসোর গার্ডেন। তারপর থেকে এই গার্ডেনটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন এর ইতিহাসের কথা।


তথ্য সহায়তা: ডঃ স্বপনকুমার গোস্বামী ও দিব্যেন্দু ব্যানার্জি।

Comments

  1. সত্যিই অনেক অজানা তথ্য দিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete
  2. বাহ্ ভালো ইনফরমেশন। সুন্দর।

    ReplyDelete
  3. সমৃদ্ধ হলাম যথারীতি

    ReplyDelete
  4. ভীষণ ভালো লাগে তোমার এই তথ্য বহুল পোষ্ট এর জন্যে KNK টা।

    ReplyDelete
  5. But the adjacent incinerator dampens the very beauty of this temple and garden

    ReplyDelete
  6. বাহ্, বেশ সুন্দর লিখেছেন, অত্যন্ত তথ্য বহুল লেখা এটি @*🙏👌❤

    ReplyDelete
  7. আপনার লেখা উৎসাহিত করল আমাকে/আমাদের পার্ক টি দেখবার জন্য

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)