বজবজের প্রাচীন পরিত্যক্ত বারুদঘর (Old Abandoned Barood Ghar at Budge Budge)

বজবজের অছিপুরে অনেকেই পিকনিক করতে যান। এখানে আছে ভারতের প্রাচীনতম চিনে মন্দির, যা অনেকেরই অজানা। এছাড়াও নদীর ধারে আছে টং আছুর সমাধি। সেগুলো সম্পর্কে আমি আগের ব্লগে লিখেছি (http://salilhore.blogspot.com/2021/08/chinese-settlement-in-bengal-and-oldest.html)

টং আছুর সমাধিকে ডান হাতে রেখে, নদীর ধারে দিয়ে ১ কিমি মতো এগিয়ে গেলে পরবে মায়াপুর। বাম দিকে দেখা যায় একটা বড়ো মাঠের মধ্যে কিছু পুরোনো বাড়ি ও গুদামঘরের ধ্বংসস্তুপ। জমিটা বর্তমানে কোলকাতা পোর্টের অধীনে। এই ভগ্নস্তুপগুলোকে স্থানীয় লোকজন সিরাজের বারুদঘর বলে। কিন্তু কি এই বারুদঘর? কেনই বা নদীর ধারে এগুলো গড়ে উঠেছিল? এই বিষয়ে লেখার জন্যই এই ব্লগ।


সিরাজের সাথে এই বারুদঘরের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং আছে কোলকাতা বন্দরের সম্পর্ক। ১৭৭৭ সালে খিদিরপুরে বন্দর গড়ে উঠলে, বৃটিশ অধিকৃত ভারতের বণিকরা তাদের বাণিজ্য-জাহাজগুলো এই বন্দরে নিয়ে আসতে শুরু করে। এমন কি, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এবং অন্যান্য বিদেশিরা পাল তােলা জাহাজ নিয়ে, এই খিদিরপুর বন্দর থেকে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। এটা সেই সময়ের কথা বলছি, যখন হুগলি নদীতে মগ দস্যুদের উৎপাত ছিল ভীষণ রকম। কোনো জাহাজই তাদের হাত থেকে রক্ষা পেত না। এর ফলে বণিকরা তাদের প্রতিটি জাহাজে বাণিজ্যিক পণ্যের সঙ্গে, নাবিকদেরও নিরাপত্তার কারণে মজুত রাখত কামান সহ গােলা বারুদ।


সমস্ত বাণিজ্যিক তরীগুলাে এক সঙ্গে কোলকাতা বন্দরে এসে, আবার গােলা বারুদ জোগাড় করে নিয়ে, ফেরার পথ ধরত। কিন্তু একটা খুব বড়ো বিপদের সম্ভাবনা ছিল এখানে। বাণিজ্য জাহাজগুলির মধ্যে ঠাসা গােলা-বারুদ, যখন তখন বিস্ফারণ বা অগ্নিকাগ্ড ঘটার সম্ভাবনা থাকতো।

ফলে, সতর্কতা হিসেবে এই সব বাণিজ্য জাহাজ, কলকাতা বন্দরে প্রবেশ করার আগে অতিরিক্ত গােলা-বারুদ কাছাকাছি নদীর তীরে কোথাও রাখার কথা হয়, যাতে ফেরার পথে সেই সব গােলা-বারুদ সেই জায়গা থেকে আবার নিজের বাণিজ্য-তরীতে তুলে নিতে পারে। জায়গাটা হতে হবে নদীর একদম ধারে, আবার একটু নির্জন অঞ্চলে। সেই সময়ের ভারতের বৃটিশ কর্তারা আবিষ্কার করেন গঙ্গার পূর্বকূলে অবস্থিত এই মায়াপুরের নির্জন গ্রামটিকে। এখানেই মায়াপুর গ্রামের নদী কিনারে, কোলকাতা বন্দরে প্রবেশের জন্য আসা প্রতিটি জাহাজের অতিরিক্ত গােলা-বারুদ রাখার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কলকাতা পাের্ট অথরিটি মায়াপুর গ্রামের নদী তীরবর্তী ২৬ বিঘে জমি সংগ্রহ করে, গড়ে তুললো বারুদ মজুতের গুদাম ঘর, বা বারুদখানা।


প্রসঙ্গত, সেই সময় পাল তােলা জাহাজ চলাচলের জন্য, যাতায়াতের সময় খুব বেশি লাগত। তাই প্রয়ােজনের অতিরিক্ত গােলা বারুদ, বাণিজ্যের স্বার্থে ব্রিটিশরা এই মায়াপুরে মজুত করে রেখে যেত।  পরবর্তীকালে বাষ্পীয় জাহাজ চালু হলে, তাদের কুয়াশা সংকেতের জন্য কিছু বারুদ জাহাজে রেখে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বারুদ এখানে রেখে যেত। এখানে ছিল পোর্টের একটি দোতলা অফিস ও গেস্ট হাউস, আর ইগলু আকৃতির সারি সারি গুদাম ঘর। ছিল সুরক্ষাকারী ইটের মজবুত প্রাচীর। ছিল নিরাপত্তা রক্ষীদের ছাউনি। পুরো জায়গাটা বড়ো বড়ো খিরিশ গাছের শাখা-প্রশাখায় ভরে থাকত।


এবার আসা যাক জায়গাটার বর্তমান অবস্থায়। যেমন বলেছিলাম, জায়গাটা পুরোটাই ভগ্নস্তুপ হয়ে রয়েছে। মাঠটা এখন খেলা ও পিকনিকের জন্য ব্যবহার হয়, লোকজন মদ খেয়ে, বোতল ফেলে ও আরো নানানভাবে জায়গাটা নোংরা করে রেখেছে। ভাঙা দেওয়ালগুলো জামাকাপড় শুকনো আর ঘুঁটে দেবার কাজে ব্যবহার হয়।


সামনে রয়েছে নদী, সেখানে ছুটে আসে ঢেউ, আবার সে ফিরেও যায়। কিন্তু সেই দিনের সেই বারুদখানা আজো বৃটিশ বাণিজ্যের স্মৃতিময় স্থান হয়ে বেঁচে আছে।


বিশেষ তথ্য সহায়তা: ধ্রুব রায়।

তথ্যসূত্র: বজবজ পরিচয় - গণেশ ঘোষ

Comments

  1. সিরাজের গোলা বারুদ কেন বলা হয়?

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)