বাংলায় চিনেদের বসতি স্থাপন ও প্রাচীনতম চিনে কবরের গল্প (Chinese Settlement in Bengal and the Oldest Chinese Grave)
কোলকাতায় চিনেপাড়া বলতেই আমাদের মনে প্রথমে আসে চায়নাটাউনের কথা। আর যারা আরেকটু জানেন, তাদের মাথায় আসে টেরিটিবাজারের কথা। আমাদের জীবনে চা, চাউমিন, ডেন্টিস্ট, জুতো, আর সূক্ষ্ম কাঠের কাজের অবদান ছাড়াও... একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিনেদের অবদান আছে, সেটা হলো চিনি (Refined Sugar)। ভাবছেন তো, চিনি তো কবে থেকেই ভারতে ছিল... এর মধ্যে চিনেদের কি অবদান? হ্যাঁ, শর্করা হিসেবে চালু ছিল বটে, কিন্তু পরিশোধিত শর্করার প্রচলন করেন চিনেরাই! তাই সেই উপাদানের নাম হয় 'চিনি' (চিনেদের তৈরী জিনিস বলে)! এর উৎপত্তির সাথে জড়িয়ে আছে টং আছুর নাম, যাকে বলা হয় 'Thongyeng Pakkung (Sugar Plantation Master)।
এবার আমরা আসি অবিভক্ত বাংলার চিনেরা কিভাবে এলো, সেই বিষয়ে। এনারা কিন্তু হঠাৎ করে এসে মধ্য-কোলকাতায় বসতি গড়ে তোলেন নি! বাংলায় চিনেদের বসতি প্রথম গড়ে ওঠে বজবজের কাছে হুগলি নদীর তীরে একটা জায়গায়, যার বর্তমান নাম 'অছিপুর'। জায়গাটা কোলকাতা থেকে প্রায় ৩৩ কিমি দূরে।
বহুদিন ধরেই চিনেরা ভারতে আসছেন পর্যটক হিসেবে, যাদের মধ্যে হিউ এন সাং (Hieun Tsang) এবং ফা হিয়েনের (Fa Hien) নাম আমরা সকলেই জানি। কিন্তু স্থায়ী চাইনিজ বাসিন্দা হিসেবে আমরা প্রথম নাম পাই চা ব্যবসায়ী টং আছুর (Tong Atchew)। এনাকে ইয়াং দাজাও (Yang Dazhao), ইয়াং দাইজ্যাং (Yang Daijang) এবং ইয়াং তাই চৌ (Yang Tai Chow) নামেও আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
এই আছু ভদ্রলোক যে ঠিক কবে বজবজে পদার্পণ করেন, সেটা জানা যায় না। অনুমান করা যায়, উনি এসেছিলেন চীনের Fujiang প্রদেশ থেকে, মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে চায়ের ব্যবসার প্রসার ঘটানো। তবে উনি আসার আগেই কিছু চাইনিজ লোকজন এই অঞ্চলে কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই ছোট্ট বসতি স্থাপন করেছিল, সেটা অনেক ঐতিহাসিকও বলেছেন, এবং আমারও সেটা মনে হয়েছে।
এবার ভারতে এসে আছু কিভাবে চায়ের ব্যবসা ছেড়ে চিনির ব্যবসা নিয়ে পরলেন, সেটা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, চীনের সাথে বাণিজ্যের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৭৭৮ খৃস্টাব্দে আছু সরকারের কাছে আবেদন করেছেন একটা চিনিকল খোলার জন্য। আর জনশ্রুতি আছে, হেস্টিংসের সাথে দেখা করে, আছু খুব ভালো গুণমানের চা উপহার দেন, এবং সেই চা-পান করে হেস্টিংস এতটাই খুশি হন, যে বলেন একদিনে আছু ও তার লোকেরা যতটা জায়গায় ছড়িয়ে পরতে পারবেন, ততটা জায়গা ওনাদের কারখানার জন্য দেওয়া হবে! অবশেষে আছু সরকারের থেকে বার্ষিক ৪৫ টাকা ভাড়ায়, ৬৫০ বিঘা জমি লিজ নেন। এখানেই গড়ে ওঠে আছুর চিনির কারখানা। সেই কারখানায় কাজ করার জন্য চীন থেকে প্রচুর শ্রমিক নিয়ে আসেন আছু, আর পত্তন হয় ভারতের প্রথম চাইনিজ বসতির। কালক্রমে সেই এলাকার নাম হয়ে যায় 'আছিপুর' বা 'অছিপুর'। পরবর্তীকালে এখানে চিনি ছাড়াও, মদ উৎপাদনও শুরু হয়েছিল।
আছু মারা যান ১৭৮৩ সালে। ওনার মৃত্যুর পর থেকেই সেই কারখানার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ধীরে ধীরে জীবিকার সন্ধানে চিনেরা চলে আসে কোলকাতার টেরিটিবাজার, চাঁদনী ও বউবাজার অঞ্চলে... পত্তন হয় কোলকাতায় প্রথম চায়নাটাউনের। এদের উত্তরপুরুষদেরই আমরা আজ দেখতে পাই কোলকাতায়। এদিকে ক্যালকাটা গেজেটে ১৫ই নভেম্বর ১৮০৪ সালে আমরা একটা বিজ্ঞাপন আমরা দেখতে পাই, যাতে আছুর কারখানা ও সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির উল্লেখ আছে। এবার সেটা কাকে বিক্রি করা হয়েছিল, সেটা জানা যায় না।
এবার ফিরে আসি বর্তমানে। আজকের অছিপুরে কোনো চিনির কারখানা বা চিনেদের বসতি দেখা যায় না। এখন সেটা শুধুই একটা গ্রাম্য অঞ্চল। তবে আছুর দুটো স্মৃতি রয়ে গেছে এই অঞ্চলে এখনো। প্রথমটা হলো আছুর সমাধি, যা রয়েছে হুগলি নদীর তীরে, অছিপুর থেকে মোটামুটি এক কিমি দূরে। অনেকে বলেন যে আসল সমাধি নাকি অনেকদিন আগেই নদীভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে, তার পরে নাকি নতুন করে এই সমাধিটি বানানো হয়েছে। নদীর পাড় এখন বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই আর ভাঙ্গনের ভয় নেই।
অছিপুরে একটা পাড়া আছে, যার নাম চিনেম্যানতলা। এখানে একটা চিনে মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, যার প্রতিষ্ঠার সাল বলা হয়েছে ১৭১৮ খৃস্টাব্দ। মন্দিরটার দেখভাল করে এখন টেরিটিবাজারের 'গী হিং চার্চ ও ক্লাব'। কেয়ারটেকার হিসেবে রয়েছেন একজন স্থানীয় মুসলিম ভদ্রলোক। অন্যান্য চিনে মন্দিরগুলোর মতোই এখানে লাল হলুদ রঙের আধিক্য দেখা যায়। মন্দিরে চমৎকার চীনা ক্যালিগ্রাফি ছাড়াও, কিছু আসবাব ও পূজা সামগ্রীর সাথে সাথে রয়েছে কাঠের তৈরী এক জোড়া দেব-দেবী মূর্তি, যাদের বলা যায় পৃথিবীর দেব-দেবী (God and Goddess of the Earth)। স্থানীয়রা এনাদের 'খোদা-খোদি' (Khoda-Khodi) নামেই ডাকেন। আমার ধারণা স্থানীয় অধিবাসীরা মুসলিম সম্প্রদায়ের হবার জন্য, উর্দু শব্দ 'খুদা' থেকেই এনাদের নামের উৎপত্তি। এই মূর্তিদুটো এনেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন টং আছু। আমার ধারণা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার অনেক আগে থেকেই এই মন্দির ছিল, কারণ ১৭৭৮ খৃস্টাব্দে আছু এই চিনির কারখানা গড়ে তোলেন, এবং ১৭৮৩ সালে তিনি মারা যান। এদিকে মন্দিরের পত্তনের সাল দেখাচ্ছে ১৭১৮! খুব সম্ভবতঃ আছু আসার আগেই যে চাইনিজ লোকজন এই অঞ্চলে কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই ছোট্ট বসতি স্থাপন করেছিলেন, মন্দিরটা তাদেরই বানানো। হয়তো সংস্কার করেছিলেন আছু।
এই মন্দিরের প্রাঙ্গনেই আছে একটা চিনে স্থাপত্যে বানানো ছোট্ট নিচু মন্দির। ভিতরে ঘটে পুজো হচ্ছে বাঘের রাজা দক্ষিণ রায়ের। এতে প্রমাণিত হয়, সেই সময় এই অঞ্চল সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর বাঘের উৎপাতও ছিল প্রচুর। দুটো জনজাতি একসাথে থাকতে থাকতে, কিভাবে নিজেদের সংস্কৃতির আদান-প্রদান করে, এটা তার একটা বড়ো উদাহরণ।
বাইরে থেকে যেসব চাইনিজরা কোলকাতায় ঘুরতে আসেন, তারা এখানে এসে নিজেদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আছুর সমাধিতে প্রতীকী কাগজের অর্থ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং ধূপের কাঠি দেওয়া হয়। মন্দিরে সারা বছর তেমন ধুমধাম করে পূজা না হলেও, চিনে নববর্ষের সময় খুব আড়ম্বর করে পূজা হয়। গর্ভগৃহে ধুপ-ধুনা দেওয়া হয়, আর বিভিন্ন ফল-বিস্কুট দেওয়া হয়। এছাড়াও গোটা শুয়োরের রোস্ট আর ওয়াইনের বোতল দেওয়া হয়। তবে আমি ফেব্রুয়ারি মাসে গেছিলাম, তখনও নববর্ষের দিন আসে নি। এটা ভেবে ভালো লাগলো, এই শান্ত গ্রামটা বছরের একটা সময়ে বেশ গমগমে হয়ে ওঠে!
একটা অন্যরকম তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি। স্থানীয় সূত্রে জানতে পারলাম, টং আছু স্থানীয়দের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অছি-সাহেব। তিনি একজন স্থানীয় মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, যার নাম ছিল 'তেলি বিবি'। ওনার কবর গ্রামের ভিতরে কোথাও ছিল, কিন্তু আজকে তার কোনো চিহ্ন নেই। শুধু ভারতে চাইনিজদের বসতি স্থাপনের এক গৌরবগাথার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে হুগলি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে অছি-সাহেবের লাল সমাধিটি।
তথ্য সহায়তা:
১. Tony Lee (Naam Soon Church)
২. Dominic Lee (Owner of Pou Chong Food Products)
তথ্যসূত্র:
১. কলকাতার প্রতিবেশী, পীযূষকান্তি রায়
২. artsandculture.google.com/exhibit/achipur-india%E2%80%99s-first-chinese-settler-live-history-india/7QLCgSL39EveLw?hl=en
৩. scroll.in/magazine/826383/the-legend-of-tong-atchew-who-was-the-first-ancestor-of-the-chinese-in-india
৪. চাইনাটাউন - বদ্রিনাথ দাস (দৈনিক বসুমতি পত্রিকা)
অছিপুর ধর্মতলা থেকে কিভাবে যাব,
ReplyDeleteশিয়ালদা থেকে ট্রেনে বজবজ আসুন.তারপর স্টেশন থেকে সরাসরি অটো পাবেন।এটি আরামদায়ক পথ.
Deleteঅছিপুরের অজানা গল্প জেনে খুব ভালো লাগলো, আমি একটু অল্প লেখালেখি করি, আমি এই অছিপুরে যাবার চেষ্টা করছি। আচ্ছা আর একটি ইছাপুর উওরে আছে, তার সাথে এই অছিপুররের কি কোনো যোগাযোগ আছে?
ReplyDeleteনা,দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জায়গা.আমি বজবজ থাকি.
Delete