ময়দার পাতালভেদী দক্ষিণাকালীর গল্প (Moydah Pantal Bhedi Moydanabeshwari Kali Mandir)
কোলকাতা থেকে ৫০ কিমি দূরে, শিয়ালদা স্টেশন থেকে লক্ষিকান্তপুর লোকাল ট্রেনে বহরু স্টেশনে নেমে, ভ্যান রিকশা করে পূর্বদিকে তিন কিমি মতো গেলে একটা গ্রাম আছে, যার নাম ময়দা। এইরকম অদ্ভুত নামের নেপথ্যে আছে একটা গল্প।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার তাড়দহ এবং মেদিনীপুরের গেওখালিতে একসময় পর্তুগিজদের বসতি ছিল। সেই সময় এই অঞ্চল দিয়ে গঙ্গার একটা ধারা প্রবাহিত হতো। সেই পথেই পর্তুগিজরা এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে, আর এই গ্রাম একটি উল্লেখযোগ্য বানিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বলা হয়, পর্তুগিজ শব্দ 'মাদিয়া' থেকেই এই গ্রামের নাম হয় 'ময়দা'। শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মচরিতে আছে -- "... বহরুর নিকটবর্তী আদি গঙ্গার পূর্ব তীরবর্তী, 'ময়দা' ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। কারণ ইহা একটি রেভিনিউ পরগণার কেন্দ্রীয় দফতর ছিল, এবং পর্তুগিজদের একটি বন্দর ছিল।" এছাড়াও কবি কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যেও ময়দা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ময়দা গ্রামের পূর্বদিকে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর প্রসারিত ছিল একটা প্রাচীন রাস্তা, যার নাম ছিল 'দ্বারির জাঙ্গাল'। আদিগঙ্গার তীর বরাবর কালীঘাট থেকে ছত্রভোগ পর্যন্ত এই রাস্তার বিস্তৃতি ছিল। বর্তমানে বিলুপ্ত এই প্রাচীন রাস্তাটি ছিল হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত, তীর্থযাত্রীদের পথের একটা অংশবিশেষ। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর 'চৈতন্যচরিতামৃত' এবং বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত' থেকে জানা যায়, চৈতন্যদেব এক সময় ময়দা গ্রামের আরো উত্তরে বারুইপুরের কাছে আটিসারা থেকে ছত্রভোগ পর্যন্ত পথ অতিক্রম করেছিলেন। মহাপ্রভু বারুইপুরের আটিসারা গ্রামের অনন্ত পন্ডিতের বাড়ি থেকে, আদিগঙ্গার পূর্বতীরের দ্বারির জাঙ্গাল দিয়ে ছত্রভোগ যান, আর সেখান থেকে নৌকাযোগে পুরী গিয়েছিলেন।
বর্তমানে এই গ্রামে পর্তুগিজদের কীর্তির কোনো নিদর্শন না পাওয়া গেলেও, এই গ্রাম বিখ্যাত দেবী দক্ষিণাকালীর মন্দিরের জন্য, যা এই অঞ্চলের একটি সুপ্রাচীন মন্দির। মন্দির চত্বর বেশ বড়ো, প্রায় ৭৩ শতক জায়গা জুড়ে। মন্দিরের পশ্চিমে যে পুকুরটি রয়েছে, সেটি প্রায় এক বিঘের। মায়ের মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আছে একটি শিব মন্দির, আর এর পিছনেই উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি বকুল গাছের নিচে আছে সাধক ভবানী পাঠকের পঞ্চমুন্ডির আসন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, এই ভবানী পাঠক কিন্তু 'দেবী চৌধুরানী' খ্যাত সেই চরিত্র!
মন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণে ধর্মরাজ ঠাকুরের স্থান। এই ঠাকুরের পূজো কিন্তু ব্রাহ্মণরা করেন না, করেন রজকরা (ধোপা সম্প্রদায়)। এর পিছনে রয়েছে একটি ছোট পুকুর, যার নাম কালীকুন্ড।
দেবীর মহত্ত্বের সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এই কালিকুণ্ডের বৈশিষ্ট্য হলো, যে সব মায়ের গর্ভে সন্তান নষ্ট হয়ে যায়, কিংবা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে বাঁচে না, সেই সব মায়েরা কুণ্ডে স্নান করে, মায়ের কবচ ধারণ করলে সন্তান রক্ষা পায়। নিঃসন্তান মায়েরা এখানে স্নান করে মায়ের কবচ ধারণ করলে, সন্তানলাভ হয়।
এই কালিবাড়ির মধ্যে মায়ের মূর্তি আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জনশ্রুতি আছে, যারা এই নির্দেশ অমান্য করেছেন, সাথে সাথেই তারা প্রতিফল পেয়েছেন, এমনকি মৃত্যুও ঘটেছে। ময়দাগ্রাম এবং আশে পাশের গ্রামে, গৃহস্থের বাড়িতে কালীপূজা করা নিষিদ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ ও মেলার তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখিত আছে,
"শোনা যায়, কালীমন্দির বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদিগের দ্বারা নির্মিত। সাবর্ণ চৌধুরীরা দেবীর নিত্যপূজার জন্য বহু ভূ-সম্পত্তি দান করেন এবং অদ্যপি জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায়, শারদীয়া নবমী তিথিতে এবং কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেবীর উৎসব উপলক্ষে উক্ত চৌধুরীদিগের নামে সংকল্প করিয়া দেবীর নিকট জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হয়।"
১১৭৬ বঙ্গাব্দে, ময়দার স্বনামধন্য জমিদার গদাধর বসু চৌধুরী এই মন্দিরের সংস্কার করেন। এই অঞ্চলের মায়ের আগমন কিভাবে হলো, সেটা নিয়েও কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
যেখানে আজ মন্দিরটি অবস্থিত, সেই জায়গায় ছিল গভীর জঙ্গল, আর পাশ দিয়ে বয়ে যেত আদিগঙ্গা। একদিন ওই গঙ্গা দিয়ে এক মাঝি নৌকা বাইবার সময় শ্যামা সংগীত গাইছিল। ওই সময় জঙ্গল থেকে একটা ছোট মেয়ে বলে উঠলো - "ওরে মাঝি ফিরে গা।" মাঝি বললো - "সাধ থাকে তো ফিরে চা।" মাঝি আবার গান ধরলে, মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যায়। এই নৌকায় ছিলেন সাবর্ণ চৌধুরীদের কোনো এক পুরুষ। তিনি মাঝি-মাল্লাদের মেয়েটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, জানতে পারেন যে এখানে এই মেয়েটিকে দেখা যায়, কেউ এখনো ধরতে পারে নি।
সেই জমিদারকে পরে মেয়েটি স্বপ্নে দেখা দেন, এবং বলেন - "তুই আমাকে ধরার বৃথা চেষ্টা করছিস। আমি ত্রেতা যুগে ময়দানবের পরমারাধ্যা দেবী দক্ষিণাকালী। তুই ওই বকুল গাছের কাছে সকালে গিয়ে দেখবি বিরাট মাটির স্তূপ আছে। তার ওপরে বড়ো বড়ো গাছ আছে। গাছ কেটে মাটি খুঁড়লে আমার মূর্তি দেখতে পাবি।" সেইমতো জঙ্গল পরিষ্কার করেও, কোনো মূর্তি পাননি জমিদার। শুধু সন্ধান মেলে একটি শিলার। পরে আবার স্বপ্নদেশ হয় - "তুই এভাবে আমাকে তুলতে পারবি না। ওখানেই আমাকে মন্দির করে দে।" সেইমতো প্রতিষ্ঠা হয় এই মন্দিরের। এই কালীকে সেই জন্য ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত শিল্পী এবং লঙ্কার রাজা রাবণের শশুর ময়দানবের কালীও বলা হয়।
এই মন্দিরে কোনো মূর্তি নেই। একটি চারকোণা গর্তে দেবীর প্রতীক-স্বরূপ একটি সিঁদুরলেপা শিলাকে দক্ষিণাকালীরূপে পূজা করা হয়। এই শিলারূপী কালীকে 'স্বয়মম্ভু' বলা হয়। মায়ের অঙ্গে এবং দেবীখণ্ডে অশোকচক্রের মতো একটা দিব্যযন্ত্র আছে।
এবার আসি পূজার বিষয়ে। প্রতিদিন মায়ের পূজা ও সন্ধারতি হয়। তবে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার যারা মানসিক করেন, তাদের ভিড় বেশি হয়। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায়, শারদীয়া নবমী তিথিতে ও কার্তিক মাসের অমাবস্যায় উৎসব ছাড়া, ১লা বৈশাখ গোষ্ঠ উৎসব, আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী, ভাদ্রমাসে তালনবমী ও ১লা মাঘে গঙ্গাস্নান উপলক্ষে খুব বড়ো মেলা বসে, যা এই অঞ্চলে খুব কমই দেখা যায়
তথ্যসহায়তা:
শ্রী সুনীল সরকার ও শ্রী আদ্যনাথ বোস (ময়দা পাতালভেদী দক্ষিণা কালীবাড়ী উন্নয়ন সমিতি)
ভীষণ ভালো লাগল। যাওয়ার ইচ্ছেও রইল। আপনার লেখা পড়লেই বেড়িয়ে পরতে ইচ্ছে করে। এতো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাথে আমাদের অবগত করানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDelete