দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ : ভারতের প্রাচীনতম নিলামঘর (The Russell Exchange : Oldest Auction House of India)
সময়টা তখন মোটামুটি ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি। পৃথিবী জুড়ে বাজছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এই সময় উত্তরপ্রদেশের বেরিলি থেকে কলকাতায় ব্যাবসা করতে এলেন আব্দুল মাজিদ, মাথায় ছিল তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং হৃদয়ে ছিল পুরনো জিনিসের প্রতি ভালোবাসা। সেই সূত্রে মাজিদ-সাহেব কলকাতার এদেশীয় ধনী এবং অভিজাত পরিবারের লোকজনের সাথে আলাপ বাড়াতে শুরু করলেন। কলকাতাতে তখন ইংরেজ এবং অন্য ইউরোপিয়ানরা ধীরে ধীরে পাততাড়ি গোটাচ্ছেন। এছাড়াও চাকরির সূত্রে এদের ট্রান্সফার লেগেই থাকতো। তাই কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার সময় এরা নিজেদের সাধের ফার্নিচারগুলো নিয়ে পরতেন খুব সমস্যায়। তাই চাইতেন কোনোভাবে সেগুলো বিক্রি করে দেবার। এদিকে এদেশীয়দের মধ্যে এসব ব্যবহার করা জিনিষ এবং আসবাবের আকর্ষণ প্রবল! তাই সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মিলন করার জন্য রাসেল স্ট্রীটে আব্দুল মাজিদ খুলে বসলেন একটা নিলামঘরের ব্যবসা, নাম দিলেন 'দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ'! বিক্রির জন্য আসতে লাগলো বিরাট পিয়ানো, ঝাড়লণ্ঠন, শ্বেতপাথরের টেবিল, নরম গালিচার মতো অজস্র জিনিস। ভেনিশিয়ান বা বোহেমিয়ান গ্লাস এর জিনিস, সতসুমা টি-সেট, অধুনা দুষ্প্রাপ্য ইংল্যান্ডের রয়্যাল ডালটন বোন চায়না, জার্মানির রোসেনথাল চায়না বা নারিটাকের পোর্সেলিনের জিনিসও আসতে লাগল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইংরেজ এবং অন্য ইউরোপিয়ানরা দেশ ছেড়ে যেতে লাগলেন, আর ফুলেফেঁপে উঠতে লাগলো রাসেল এক্সচেঞ্জ। এদিকে এতদিনের অধরা স্বপ্নের জিনিষগুলো হাতের কাছে পেয়ে, নিলামঘরে ঝাঁপিয়ে পরলেন এদেশীয়রা!
শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। চাহিদা বাড়ায় প্রতি রবিবার করে নিয়মিত অকশন চালু হলো। রবিবার করে একদিকে দামী গাড়ির লাইন লেগে যেত দোকানের বাইরের রাস্তায়, অন্যদিকে সার বেঁধে অপেক্ষা করতো কুলির দল। হাতুড়ির অন্তিম ঘায়ের সাথেই নির্ধারিত হতো কাঙ্ক্ষিত বস্তুটির মালিকের নাম। তারপর সেটা কুলির পিঠে চড়ে কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী কোনো ধনী বা জমিদারবাড়িতে হাজির হতো, অথবা স্টেশন থেকে পাড়ি দিত দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদ, মালদহ বা গৌহাটির দিকে। বহু বিখ্যাত মানুষের পা পরেছে এখানে, যাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় নিয়মিত আসতেন।
রাসেল এক্সচেঞ্জের সাথে গড়ে উঠেছিল আরো অনেক অকশন হাউস, যেগুলো সময়ের সাথে সাথে হয় বন্ধ হয়ে গেছে, অথবা চলছে টিম টিম করে। আঠারো-উনিশ শতকের জনপ্রিয় অকশন হাউস ‘ম্যাকেঞ্জি লায়াল এন্ড কোং’— আফিম নিলামের জন্য যা বিখ্যাত ছিল— প্রথমে বন্ধ হয়ে যায়। পরে বন্ধ হয় রাসেল স্ট্রিটের ‘ডালহৌসি এক্সচেঞ্জ’, পার্ক স্ট্রিটের ‘চৌরঙ্গী সেলস ব্যুরো প্রাইভেট লিমিটেড’, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ‘স্টেইনার এন্ড কোং’-এর মতো বড় বড় অকশন হাউস। 'ভিক্টর ব্রাদার্স' তো কয়েকদিন আগেই বন্ধ হলো। ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে রইল রাসেল স্ট্রিটের তিনটি দোকান। তার মধ্যে ‘সুমন এক্সচেঞ্জ’ এবং ‘মডার্ন এক্সচেঞ্জ’ অনেক পরের দিকে তৈরি। নিয়মিত অকশন এরা বন্ধ করে দিয়েছে বহু দিন। ব্যতিক্রম ‘রাসেল এক্সচেঞ্জ’।
এবার ফিরে আসি বর্তমানে। সোম থেকে শনিবারের মধ্যে ব্যস্ততা যখন তুঙ্গে থাকে, সেই সময়ে দোকানটির সামনে দাঁড়ালে দেখা যায় একটা বিবর্ণ সাইনবোর্ড। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, সময় থমকে আছে এখানে। রং চটে যাওয়া গ্রামোফোন, কানন দেবীর গাওয়া গানের দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সুবিশাল সেগুন কাঠের পালঙ্ক, প্রাচীন আরামকেদারা, লতাপাতার কাজ করা দেরাজ-আলমারি, চার-পাঁচটা আয়না বসানো ড্রেসিং টেবিল, বেলোয়ারি কাঁচের ঝাড়লণ্ঠন, লণ্ঠন ধরে থাকা নারীমূর্তি, শ্বেতপাথরের টেবিল গা-ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে ভিতরে। পুরনো আসবাব আর জিনিসপত্র তো রয়েছেই, সাথে রয়েছে হেলমেট, পুরনো ঘড়ি, সাইড ব্যাগ, ট্রলি ব্যাগ, হকি স্টিক, বাতিল হওয়া ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, পোকায় খাওয়া বই-ম্যাগাজিন এমনকি খানদুয়েক পারিবারিক অ্যালবামও বিরাট একটা টেবিলের ওপর ডাঁই করে রাখা। পুরনো আসবাব আবার সারাই করে পালিশ করা হচ্ছে। প্রতি রবিবার করে এখনো নিলাম হয়। তবে বিক্রির জিনিষ এবং খদ্দেরদের প্রকৃতির মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে এখন। উচ্চবিত্ত অভিজাত পরিবারের লোকজন ছাড়াও এখানে মধ্যবিত্ত এবং নিন্মবিত্ত লোকজনও ভীড় করেন... পুরনো ভালো জিনিষ একটু কমদামে পেয়ে যাবার আশায়! এখানে এখন নিলামের জন্য সরাসরি জিনিষ এনে বিক্রি করা যায়, যায় জন্য রাসেল এক্সচেঞ্জ নেবে বিক্রির দামের ২০%।
মাজিদের পরে এই দোকানের হাল ধরেছিলেন মেয়ে সরফরাজ বেগম। তিনি দায়িত্ব ছাড়েন ছোট ভাই আরশাদ সেলিমের ওপরে, যিনি এই নিলামঘরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। দেশের 'কনিষ্ঠতম অকশনিয়ারের' মুকুট রয়েছে তারই মাথায়। তবে চলার পথ সহজ হয় নি তার। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো ব্যবসায় দারুণ মন্দা, তার সাথে শুরু হলো বড়ো ভাই আনোয়ার সেলিমের সাথে ব্যাবসা চালানো নিয়ে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। সব কিছু কাটিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করে দোকানটির। রাসেল এক্সচেঞ্জের ঐতিহ্য ও ব্যবসা নিয়ে দুই ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির তফাত, তাঁদের মিঠেকড়া সম্পর্ক, এই সব নিয়েই লন্ডনের তথ্যচিত্র নির্দেশক এডওয়ার্ড ওলস্ ‘দি অকশন হাউস, আ টেল অব টু ব্রাদার্স’ নামে তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে তা। এখানে যা কিছু বিক্রি হয়, তার বয়স ১০০ বছরের নিচে, যাকে বলে 'পিরিয়ড পিস'।
বর্তমানে লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে বাজারে সহজলভ্য চাইনিজ প্রোডাক্টের জন্য। নিউমার্কেটে হুবহু এই নকশা আর ডিজ়াইনের চাইনিজ় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে এখন। সেগুলো সস্তা, সহজলভ্য। ফলে সেই দিকে মানুষ ঝুঁকছে বেশি। তাও নস্টালজিক শহরের রবিবারগুলো আজও স্পেশাল হয়ে ওঠে, যখন দোকানের বাইরে দেখা যায় একটা ব্ল্যাকবোর্ড, যেখানে গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখা হয়ে আসছে— ‘অকশন হিয়ার টুডে’।
তথ্যসূত্র:
১. anandabazar.com/rabibashoriyo/oldest-auction-house-of-india-1.846303
২. outlookindia.com/travel/visit-the-russell-exchange-auction-house-for-rare-finds-news-185972
৩. therussellexchange.com
৪. livemint.com/Leisure/RBlI9B15Gc3BH2dhkR5QeM/Russell-Exchange-auction-house-Everything-is-saleable.html
Comments
Post a Comment