গন্ধেশ্বরী মন্দির, কোলকাতা (Gandheswari Temple, Kolkata)

গন্ধেশ্বরী মন্দিরের কথা বলতেই আমাদের হুগলি জেলার বিখ্যাত মন্দিরটির কথা মনে পরে। কিন্তু আমাদের খোদ কোলকাতার বুকেই রয়েছে একটি গন্ধেশ্বরী মন্দির, যা খুব প্রাচীন না হলেও বেশ প্রসিদ্ধ। এই মন্দিরটি উত্তর কোলকাতায় ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির কাছেই, বলক দত্ত লেনে প্রতিষ্ঠিত। তবে এই মন্দিরের বিষয়ে আরো জানার আগে, আমরা দেখে নেব, বেদব্যাস রচিত 'মহানন্দীশ্বর পুরাণ'-এ দেবীর উৎপত্তি সম্পর্কে কি বলা হয়েছে।



সুভুতি নামের এক ব্যক্তির পুত্র হলেন গন্ধাসুর। বেনেদের হাতে বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে এই গন্ধাসুর তপস্যা করে বলীয়ান হয়ে ওঠে, এবং বেনেদের ওপরে চরম অত্যাচার শুরু করে। একদিন সে আক্রমণ করে সুবর্ণবট নামের এক সমৃদ্ধ বেনের বাড়িতে, এবং তাকে হত্যা করে। সুবর্ণবটের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী চন্দ্রাবতী কোনোভাবে জঙ্গলে পালিয়ে বাঁচে এবং জঙ্গলের মধ্যেই একটি কন্যাসন্তানকে জন্ম দিয়ে মারা যায়।

সেই জঙ্গলের মধ্যেই ছিল ঋষি কশ্যপের আশ্রম। দেবী মহামায়া তাকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন, এবং সেই কন্যাটিকে লালন-পালন করার আদেশ দিলেন। মেয়েটির শরীর থেকে অপূর্ব সুগন্ধ বের হতো সবসময়। তাই ঋষি মেয়েটির নাম রাখলেন গন্ধবতী।

সময়ের সাথে সাথে গন্ধবতী যুবতী হয়ে উঠলে, ঋষি তাকে মা-বাবার মৃত্যুর কারণ জানালেন। তাই প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি কঠোর যজ্ঞে বসলেন। এদিকে, গন্ধবতীর রূপ ও সুগন্ধের কথা পৌঁছে গেছে গন্ধাসুরের কানে। তাই কামার্ত হয়ে সে পৌঁছে গেল আশ্রমে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে যজ্ঞের আসন থেকে তুলতে না পারায়, গন্ধবতীর চুল ধরে টানাটানি করতে লাগলো!

এই অনাচার দেখে, যজ্ঞকুণ্ডের ধোঁয়ার মধ্যে থেকে আবির্ভাব হলো সিংহবাহিনী দেবীর। তিনি গন্ধবতীকে অভয় দিয়ে, গন্ধাসুরের সাথে প্রবল যুদ্ধ শুরু করলেন। অনেক যুদ্ধের পরে, ত্রিশূলের আঘাতে দেবী হত্যা করলেন গন্ধাসুরকে। তার বিরাট শরীর তিনি নিক্ষেপ করলেন সমুদ্রে, যা পরিণত হলো একটি সুফলা দ্বীপে। সেই দ্বীপে উদ্ভূত হল মশলা ও সুগন্ধদায়ী বৃক্ষ-লতা-বীরুৎমালা। দেবী সেই দ্বীপের নাম দিলেন, গন্ধদ্বীপ। বেনে-সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠীকে দেবী এই দ্বীপ থেকে গন্ধদ্রব্য আহরণ করে বাণিজ্যের অধিকার দিলেন, তাদের নাম দিলেন, 'গন্ধবণিক'।

গন্ধাসুরকে বধ করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন বলে, সমস্ত দেবতারা এই নবদেবীকে 'দেবী গন্ধেশ্বরী' বলে সম্বোধন করলেন। দেবী গন্ধেশ্বরী যেদিন গন্ধাসুরকে বধ করলেন সেদিনটা ছিল বৈশাখী পূর্ণিমার দিন। তাই অচিরেই তিনি গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের পরম আরাধ্যা দেবী তো হয়ে উঠলেনই, সেই সঙ্গে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন সমস্ত বেনেদের কাছেও মহাধুমধামে বাৎসরিক পুজো পেতে শুরু করলেন।

এবার মন্দিরের বিষয়ে ফিরে আসি। এই মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন স্বর্গীয় বটকৃষ্ণ পালের পুত্র হরিশঙ্কর পাল, এবং মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে। অষ্টধাতু-নির্মিত প্রতিমাটি প্রায় তিন-ফুট লম্বা। দেবী চতুর্ভূজা এবং সিংহের ওপরে আসীন। সিংহটি আবার দাঁড়িয়ে আছে গন্ধাসুরের শরীরের ওপরে।


মন্দিরটি প্রথম থেকেই গন্ধবণিক মহাসভার দ্বারাই  পরিচালিত হয়। বৈশাখী বা বুদ্ধ পূর্ণিমায় খুব বড়ো করে পূজা হয়। গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা এইদিন তাদের হিসেব খাতা এবং ওজন পরিমাপের যন্ত্র দেবীর সামনে সাজিয়ে রাখেন। গন্ধেশ্বরী দেবীর আশীর্বাদ নিয়েই সারা বছরের ব্যবসার সমৃদ্ধি কামনা করা হয় এই দিনে।



গন্ধবণিক সম্প্রদায়-এর আভিধানিক অর্থ সুগন্ধির বণিক, তারা ঐতিহ্যগতভাবে বাংলায় মশলা, সিঁদুর, এলাচ, চন্দন কাঠ, সুগন্ধি প্রসাধনী, সুগন্ধি ধূপ এবং হরিণ কস্তুরীর ব্যবসায়ী। তাদের ইতিহাস এবং অস্তিত্ব ধনপতি সওদাগর, শ্রীমন্ত সওদাগর এবং চাঁদ সওদাগরের সময় থেকেই আছে , যারা ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। বর্তমানে, গন্ধবণিকরা নানান ধরণের ব্যবসায়ে এসেছেন, যেমন ওষুধ-অস্ত্র প্রভৃতি। বন্দুক ব্যবসায়ী এন. সি. দাঁয়ের পরিবার, শোভাবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বটকৃষ্ণ পাল... এনারাও জাতিতে গন্ধবণিক।

এই মন্দিরে বৈশাখী পূর্ণিমায় গন্ধেশ্বরী পূজা একটি বিশাল উৎসব। সেদিন দেবীকে খিচুড়ির সাথে  চচ্চড়ির ভোগ নিবেদন করা হয়, যা পরে মন্দিরে উপস্থিত সকল ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সকল জনসাধারণকে এই দিন পুজোয় যোগ দেওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মন্দিরের রোজকার দর্শনের সময় - সকাল ৯ থেকে ১১টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা।



মন্দিরের গুগল ম্যাপের লোকেশন আমি নিচে দিলাম।
Gandheswari Temple
https://maps.app.goo.gl/FLL2N4taTHf5Yx9H6

তথ্যসহায়তা: স্বপন কুমার দত্ত এবং ডালিয়া মুখার্জী।

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)