বটকৃষ্ণ পাল : এক অবিস্মরণীয় বাঙালি ব্যবসায়ী (Bata Krishna Pal : An Unforgotten Bengali Businessman)

হেদুয়ার লেকের যেই দিকটাতে ক্রাইস্ট চার্চ রয়েছে, সেখানে পার্কের ধারে একটি মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি এক বাঙালি ভদ্রলোকের, ধুতি-চাদর পরিহিত এবং বাম পায়ের ওপরে ডান পা তুলে বসে আছেন। চোখে মুখে রয়েছে আত্মপ্রত্যয়ী ভাব। এই ভদ্রলোকের নাম বটকৃষ্ণ পাল। ইনি দেখতে খুব সাধারণ হলেও, ভারতীয় চিকিৎসাজগতে তিনি এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। এনার নামেই উত্তর কোলকাতার বি. কে. পাল এভেনু। 


শোভাবাজার স্ট্রিট ধরে হাঁটলে, হাটখোলা পোস্ট অফিস পেরিয়ে ৯২ নম্বর (পুরোনো ঠিকানা ৮২, বেনিয়াটোলা ষ্ট্রীট) তিনতলা বাড়িটার সামনে এলে থমকে যেতে হয়। আশেপাশের সব পুরোনো বাড়িগুলোর থেকে এটা অনেকটাই আলাদা, যেন শিল্পী পরম যত্নে বানিয়েছেন এই বাড়ির সব নকশা। বাড়ির ভিতরে রয়েছে একটি ডিস্পেনসারি, আর ওপরে লেখা আছে ‘বটকৃষ্ণ পাল, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট’। এটি ভারতের প্রথম হাসপাতালের বাইরের ২৪ ঘন্টা খোলা থাকা ওষুধের দোকান। 


শুরুটা কিন্তু একদিনে হয় নি। হাওড়া শিবপুরে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল বটকৃষ্ণর। শোভাবাজার অঞ্চলে ছিল তার মামার বাড়ি, তাই দারিদ্রের তাড়নায় মাত্র ১২ বছর বয়সে চলে এলেন এখানে, মামার মশলার ব্যবসায় কাজ শুরু করলেন। কিছুদিন কাজ করার পরে আলাদা করে ব্যবসা করার কথা ভাবলেন। সেই সময় সাহেবদের কল্যাণে আফিমের ব্যবসা রমরমা! তাই ১৬ বছর বয়সে শুরু করলেন আফিমের ব্যবসা। কিছুদিন পরে আবার শুরু করেছিলেন পাটের ব্যবসা। কিন্তু ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। 


এর মধ্যে তার মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এলো। চিকিৎসার জন্য আগে কোলকাতার মানুষ কবিরাজি ও হোমিওপ্যাথির ব্যবহার করতো। পরবর্তীকালে, শহরে অ্যালোপ্যাথির ব্যবহার যখন বাড়তে শুরু করল, তখন সেই রাস্তাকে কাজে লাগালেন বটকৃষ্ণ পাল। তৈরি করলেন নিজের আরেকটি কোম্পানি ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোম্পানি’। সেখানে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির ওষুধ তো রাখলেনই, সাথে বানাতে শুরু করলেন নিজেদের ওষুধ। বাড়ির নিচেই ডিসপেনসারি, সঙ্গে নিজস্ব ল্যাব; দেশীয় ফর্মুলায় নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করতে লাগলেন তিনি। বটকৃষ্ণ পালের ফার্মেসির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি ম্যালেরিয়া ওষুধ ‘এডওয়ার্ড টনিক’ এভাবেই তৈরি হলো। এই ওষুধ ব্যবসাতেই বিখ্যাত হয়ে উঠলেন বটকৃষ্ণ। বাংলার গন্ডি ছাড়িয়ে, সারা ভারতে ব্যবহার হতে লাগলো; এমনকি বিদেশেও যেতে লাগলো তার ওষুধ। 


শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও কাজ করেছেন বটকৃষ্ণ। শিবপুরে একটি উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন যা পরবর্তীতে বি. কে. পাল ইন্সটিটিউসান নামে পরিচিত হয়। এছাড়া বেনিয়াটোলাতে বালক বালিকাদের জন্য প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি যেমন দুহাতে টাকা রোজগার করেছেন, তেমনই দানও করেছেন অকাতরে। নিজের ‘এডওয়ার্ড টনিক’ গরীবদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়েও দিয়েছেন। 


ভারতের পরাধীনতা ঘোচানোর জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। কিন্ত নিজের ও ব্যবসার সুনাম রক্ষা করার জন্য, সাহেবদের কাছে বিশ্বস্ত সেজে থাকতেন। খুব গোপনে, বিপ্লবীদের বিভিন্ন বিস্ফোরক উপাদানের যোগান দিতেন তিনি। নিজের ল্যাব থাকার জন্য সেগুলো সংগ্রহ করা খুব সহজ ছিল তার জন্য। ফার্মেসী সারা রাত খোলা থাকতো, সেই সময়ই গভীর রাতে বিপ্লবীরা এসে নিয়ে যেতেন সেসব সরঞ্জাম। নিজের খ্যাতিকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মজবুত ঢাল হিসেবে; আর তার পেছনে চলত স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রস্তুতি। 

১৮৮২ সালে বটকৃষ্ণ ব্যবসা থেকে অবসর নেন, এবং কাশীতে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পরে উত্তরপুরুষেরা সেই ব্যবসা এখনো সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। 

তথ্যসূত্র:
১. কলিকাতার রাজপথ, অজিত কুমার বসু।
২. wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%9F%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)