বন্দেমাতরম ভবন, চুঁচুড়া হুগলি : নামকরণের সত্যতা (Vandematram Bhaban, Chuchura Hooghly : Justification of Naming)
হুগলি জেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হুগলি নদী। এই নদীর পাশে রয়েছে অনেকগুলো ঘাট, যার মধ্যে জোড়াঘাট অন্যতম। এই দুটি ঘাট বেশ প্রাচীন, যার সাথে জড়িয়ে আছে হুগলির ফৌজদার মালিক কাশেমের (১৬৬৮-১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দ) নাম। জলদস্যুদের ওপরে নজর রাখার জন্য, হুগলি নদীর পূর্বপাড়ে একটি প্রসাদপম বাড়ি বানান। এই বাড়ির দুটি ঘাট ছিল, একটি বাড়ির লোকেদের ব্যবহারের জন্য, আর অন্যটি জনসাধারণের জন্য। সেই থেকেই এই অঞ্চলটির নাম হয়ে যায় জোড়াঘাট। কাশেমের মৃত্যুর পরে, বাড়ির মালিক হন হাজীবাবা বিন হাজী গোলাম হোসেন কাজারেনী।
এবার ঘটনাটা নিয়ে আসা যাক ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এই বছরের মার্চ মাসেই সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হুগলীতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেকটরের পদে যোগদান করেন। কিছুদিন পরেই কর্মক্ষেত্রের সুবিধার্থে তিনি কাজারেনীর থেকে প্রাসাদের উত্তরদিকের কিছুটা অংশ ভাড়া নিয়ে, বসবাস করতে শুরু করেন। বাড়িটির স্থাপত্যরীতি অতুলনীয়, এবং মুঘল ও ডাচ দুই রকম শৈলীর মিলনে সৃষ্ট।
এই সময়টা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য রচনার স্বর্ণযুগ। তার এই জোড়াঘাটের বাড়ির বৈঠকখানায় বসতো সাহিত্য চর্চা এবং তর্ক-বিতর্কের আসর; আসতেন সেকালের বহু নামকরা কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার প্রমুখেরা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, রামগতি ন্যায়রত্ন, তারাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সেকালের স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকরা এসেছেন এই বাড়িতে। সাহিত্যিক চন্দ্রনাথ বসুর লেখায় ধরা পড়েছে সেই বিবরণ --- “…তাহার দিনকতক পরে বঙ্কিমবাবু হুগলীতে বাসা করেন। দুইটি বাড়ী ভাড়া করেছিলেন। জোড়াঘাটের ঠিক দক্ষিণে দুইখানা বাড়ীর পর একটি বাড়ী তাঁহার অন্দর ছিল। অন্দর-বাটীর পূর্ব্বাংশের চাতালটি স্তম্ভোপরি নির্ম্মিত। উহার নীচ দিয়া গঙ্গার স্রোত প্রবাহিত হইত। ঐ চাতালে দাঁড়াইয়া বঙ্কিমবাবু একদিন বলিয়াছিলেন- “সন্ধ্যার পর আমরা এইখানে বসিয়া থাকি।’ … বৈঠকখানা-বাড়ীতে তিনটি ঘর ছিল; তন্মধ্যে মাঝের ঘরটি সর্ব্বাপেক্ষা বড়। সেই ঘরে গঙ্গার দিকে একটি বাতায়নের পার্শ্বে একখানি ইজিচেয়ারে বসিতেন। কথা কহিতেন, আর গঙ্গা দেখিতেন।…” [“বন্ধুবৎসল বঙ্কিম” – চন্দ্রনাথ বসু]। এছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং লিখেছেন --- “একদিন বর্ষাকালে গঙ্গাতীরস্থ কোন ভবনে বসিয়াছিলাম। প্রদোষকাল – প্রস্ফুটিত চন্দ্রালোকে বিশাল বিস্তীর্ণ ভাগীরথী লক্ষবীচিবিক্ষেপশালিনী – মৃদু পবনহিল্লোলে তরঙ্গভঙ্গচঞ্চল চন্দ্রকরমালা লক্ষ তারকার মত ফুটিতেছিল ও নিবিতেছিল। যে বারেন্ডায় বসিয়াছিলাম তাহার নীচে দিয়া বর্ষার তীব্রগামী বারিরাশি মৃদু রব করিয়া ছুটিতেছিল। আকাশ নক্ষত্র, নদীবক্ষে নৌকায় আলো, তরঙ্গে চন্দ্ররশ্মি। কাব্যের রাজ্য উপস্থিত হইল।”
জোড়াঘাটের এই বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন প্রায় ৫ বছর। এই সময়ে তিনি রজনী (১৮৭৭), উপকথা (ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয় ও রাধারানী একসাথে) (১৮৭৭), কবিতা পুস্তক (১৮৭৮), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৯), সাম্য (১৮৭৯) ইত্যাদি বইগুলি প্রকাশ করেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘কমলাকান্তের পত্রাবলী’, ‘রাজসিংহ’, ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’, ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী’, ‘আনন্দমঠ’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলি। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি হুগলির জোড়াঘাটের বাড়িটি ছেড়ে চলে যান হাবড়াতে।
অনেক হাত ঘুরে, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বাড়িটি অধিগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তবে সঠিক সংস্কারের অভাবে বাড়িটি প্রায় ধ্বংসস্তুপ হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাড়িটি সংস্কার করা হয়। স্থানীয় কিছু গবেষকরা মনে করেন যে এই বাড়িতেই বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেছিলেন বন্দেমাতরম গানটি, আর সেই মত অনুযায়ী বাড়িটির নামকরণ করা হয় "বন্দেমাতরম ভবন"। রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এখানে ভবিষ্যতে গড়ে তোলা হবে একটি মিউজিয়াম।
এবার একটা বিতর্কমূলক বিষয়ের অবতারণা করি। যদিও কিন্তু মানুষ মনে করেন যে এখানে 'বন্দেমাতরম' রচিত হয়েছিল, কিন্তু তথ্য এবং প্রমাণ কিন্তু অন্য কথা বলে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ঋষি শ্রীঅরবিন্দের একটা লেখায় আমরা পাই - “It was thirty two years ago that Bankim wrote his great song and few listened; but in a sudden moment of awakening from long delusions the people of Bengal looked round for the truth and in a fated moment somebody sang Bandemataram.” অর্থাৎ, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় বন্দেমাতরম, আর বঙ্কিম হুগলিতে আসেন ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বঙ্গদর্শন পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ। তার একটা লেখাতেও এই তথ্যের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায়। “বঙ্গদর্শনে মাঝে মাঝে দুই এক পাতা ম্যাটার কম পড়িলে পন্ডিতমশায় আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন। তিনি তাহা ঐ দিনেই লিখিয়া দিতেন। ঐ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মধ্যে দুই একটি লোকরহস্যে প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রকাশিত হয় নাই। বন্দেমাতরম গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পন্ডিতমহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় এক পাতা ম্যাটার কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, আচ্ছা আজই পাবে। একখানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পন্ডিতমহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজখানিতে বন্দেমাতরম গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতটি লেখা আছে – উহা মন্দ নয় তো – ঐটা দিন না কেন। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজখানি টেবিলের দেরাজের ভিতর রাখিয়া বলিলেন, উহা ভাল কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে – আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।” অর্থাৎ এই গানটি লেখা হয়েছিল যে সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু হুগলিতে বসবাস করার আগেই তিনি সেই পাট চুকিয়ে চলে এসেছিলেন; অর্থাৎ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের আগেই গানটি লেখা হয়েছিল।
বাড়িটিতে বন্দেমাতরম সৃষ্টি হয়ে থাকুক বা না থাকুক, এখানে বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং বসবাস করেছেন এবং প্রচুর জ্ঞানী-গুণী মানুষ এসেছেন। তাই বাড়িটির যে সংস্কার হয়েছে, সেটাই আমাদের কাছে সবথেকে বড়ো পাওনা।
তথ্যসূত্র:
১. হুগলী চুঁচুড়ার নানা কথা (প্রথম খণ্ড) – অক্ষয়কুমার আঢ্য
২. হুগলী জেলার ইতিহাস – সুধীর কুমার মিত্র
৩. Bengal District Gazetteers – Hooghly – L.S.S. O’Malley & Monmohan Chakravarti
৪. বঙ্কিম প্রসঙ্গ – সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সঙ্কলিত
৫. বঙ্কিম-জীবনী – শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment