দত্তচৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো, আন্দুল হাওড়া (Dutta Chowdhury Family Durgapuja, Andul Howrah)

আন্দুল অঞ্চলের এক প্রাচীনতম পরিবারের দুর্গাপুজো হলো দত্তচৌধুরীদের পুজো। চতুর্দ্দশ শতকের শেষ ভাগে এই পরিবারের পূর্বপুরুষ দেবদাস (তেকড়ি) দত্ত, পৈতৃক সম্পদের সাহায্যে এই অঞ্চলে ২৫২ বিঘা জমির উপর তার প্রাসাদ নির্মাণ করেন, এবং সেখানে তাঁর জমিদারি পত্তন করেন। তেকড়ি দত্ত ছিলেন দক্ষিণরাঢ়ীয় সমাজের 'বালির দত্ত' কুলের দ্বাদশ পুরুষ। সেই সময় আন্দুল ছিল মুজঃফরপুর পরগনার অধীনে। তৎকালীন স্বাধীন বাংলার সুলতান তাঁর সেই প্রতিপত্তি বিচার করে তাঁকে সে পরগনার রাজস্ব সংগ্রহকারী পদে নিযুক্ত করে চতুরঙ্গ প্রদান করেছিলেন। সেই চতুরঙ্গ দলধারী থেকে 'চৌধুরী' শব্দ এসেছে। এভাবেই আন্দুল সমাজে দত্তচৌধুরী পরিবারের উত্থান ঘটে। স্থানীয়রা এঁদের 'আন্দুলের চৌধুরী' নামে বেশি চেনে। এই চৌধুরীরাই ছিল আন্দুল জনপদের আদিনৃপতি, একথা আন্দুলাধিপতি রাজা রাজনারায়ণ রায়ও উল্লেখ করে গেছেন। 

বর্তমানে আন্দুল দত্তচৌধুরী বংশে যে দুর্গোৎসব দেখা যায় তা শুরু করেছিলেন চৌধুরী রামশরণ দত্ত (১৫৪৮-১৬০৬) ইং ১৫৬৮ সালে। মুজঃফরপুর পরগনার উনি ছিলেন 'বড় কুমার', তথা সষ্টম চৌধুরী। ঘোড়ার আকৃতির সিংহের মহিষমর্দিনীরূপে দেবীর পুজো শুরু হয়, প্রাসাদের কাছেই একটি খড়ের আটচালাতে, আর সেই সময় বলির প্রথা ছিল। কুলদেবতা শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বর নারায়ণের ভগিনী রূপে এখানে দেবীর নাম 'শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বরী ঠাকুরাণী'। পরবর্তীকালে রামশরণের ষষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র কাশীশ্বর দত্তচৌধুরী, তৎকালীন মুঘল সম্রাটের শাহ জাহানের সাহায্যে ১৬২৪ খ্রীষ্টাব্দে আন্দুলে তাদের পৈতৃক জমিদারি পুনরাধিকার লাভ করে তাঁদের পুরোনো প্রাসাদ ত্যাগ করে, তাঁর দাদাদের সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন প্রাসাদ এবং পাকা দুর্গাদালান নির্মাণ করেন। দুর্গাপুজো সেই নতুন দুর্গাদালানেই হতে থাকে। দালানের পাশেই আছে এঁদের শ্ৰীশ্ৰীকাশীশ্বরাদি চারটে দেবোত্তর শিবলিঙ্গ মন্দির। তবে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে সেই দুর্গাদালানটি ভেঙে পড়ে। সেই জায়গাতেই পরের বছর পাঁচ খিলান এবং দুই দালানের একটা নতুন দুর্গাদালান নির্মিত হয়, যেখানে আজও পুজো হচ্ছে। তবে সিংহের এখন সাধারণ রূপেই রয়েছে, ঘোড়া রূপে নেই। তবে বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ ও গুপ্তপ্রেস মতানুসারে এখানে পুজো হয়।

কৃষ্ণনবমী তিথীতে দেবীর বোধন হয় আর শেষ হয় দুর্গানবমীতে, অর্থাৎ দেবী চণ্ডির কল্পারম্ভ ও ঘট বসে যায় পুজোর ঠিক বারোদিন আগে থেকে। দেবীপক্ষতে পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদেরও হাতে শাঁখা পরতে হয় (নোয়া বাদে)। দেবীর অন্নভোগের সাথে পুরীর লম্বা জিভেগজা দেওয়া হয় অন্যান্য মিষ্টি ও ফলের সাথে। সপ্তমী ও মহাঅষ্টমীর দিন হয় খিচুড়ি, আর মহানবমীর দিন হয় পোলাও ভোগ। পুরনো রীতি মেনে এখনও বাড়ির সদস্যদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের সময় "বাবা, রামশরণের কড়াই ধর" বলার চল আছে। তবে পাঁঠাবলি বহুবছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, যখন পাঁঠাবলি হত, সেই বলির মাংস ভক্ষণ এঁদের নিষিদ্ধ ছিল। তার জায়গায় নবমীর দিন এসেছে আখবলি, চালকুমড়ো বলি এবং চালের পিটুলি দিয়ে মানুষাকৃতি তৈরী করে হয় 'শত্রু বলি'। এখানে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ মেয়ের কুমারী পুজো করা হয়। ধুনো পোড়ানো, হোমাদি ওই মহানবমীর দিনই হয়ে থাকে। পুজোর কাজ মূলত এখানে টৌলেরা করে থাকে।  

বিজয়া দশমীর সন্ধ্যের সময় বাড়ির বৌরাণীরা দেবীকে বরণ ও কনকাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। পাড়ার বৌররাও আসে দেবীকে বরণ করতে, কারণ ৪৫৬ বছর আগে যখন জমিদার রামশরণ দত্তচৌধুরী এই দুর্গোৎসব শুরু করেছিলেন, তখন তিনি সবাইকে নিয়েই শুরু করেছিলেন। এরপর আন্দুলের লাগোয়া ঝোড়হাট গ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা দেবীকে তাদের কাঁধে করে শোভাযাত্রার সঙ্গে নিয়ে যায় আন্দুলের দুলেপাড়ায়। এই দুলেরা ছিল একসময় এই দত্তচৌধুরীদের পাল্কিবাহক। এই শোভাযাত্রায় দত্তচৌধুরী পরিবারের কোনো মেয়ে বা বৌরাণীরা অংশগ্রহণ করার নিয়ম নেই। ওই দুলেপাড়াতে পুনরায় তাঁদের বৌরা বরণ করার পর পুনরায় দেবীকে শোভাযাত্রা করে দত্তচৌধুরীদের নিজ পাড়া 'চৌধুরী পাড়া'-য় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। আগে সরস্বতী নদীর তীরে পরিবারের নিজস্ব ঘাট ছিল, সেখানেই প্রতিমা নিরঞ্জন হতো। সেই ঘাট সংস্কার করেছিলেন বেচামনী চৌধুরাণী। এখন পরিবারের দালানের কাছে দেবোত্তর জলাশয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। ওই জলাশয় খনন করেছিলেন রায়বাহাদুর মাধব চন্দ্র দত্তচৌধুরী। 

দত্তচৌধুরীদের আজ হাতিশালা, ঘোড়াশালা বা ২৫৬ বিঘার উপর সেই সুবিশাল প্রাসাদ নেই, এই বংশের অধিকাংশ সদস্যরাই কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে, আন্দুলে বর্তমানে মাত্র দুঘর রামশরণ বংশীয় চৌধুরীদের বাস - বনবেহারী দত্তচৌধুরী (বুনো চৌধুরী) ও কিষান চাঁদ চৌধুরীর পরিবার, কিন্তু এঁদের দুর্গাপুজো সকলকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। কলকাতার 'হাটখোলার দত্ত' এই চৌধুরীদের এক উল্লেখযোগ্য শাখা। এঁদের সুবৃহৎ বংশাবলী আজও এঁদের আন্দুলের চৌধুরী বাড়িতে দেখা যায়।
তথ্য সহায়তা: শ্রী ধ্রুব চৌধুরী, যিনি এই পরিবারের সদস্য। উনি সাহায্য না করলে এতো বিস্তৃতভাবে আমি লিখতে পারতাম না।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)