ইছাপুর নবাবগঞ্জের মন্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো, উত্তর ২৪ পরগণা (Durga Puja of Mondal Bari, Ichhapur Nawabganj North 24 Pgs)

এই বাড়ির পুজোর ইতিহাস প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো। ইছাপুরের এই অঞ্চলটি তখন নবাবগঞ্জ হয়ে ওঠেনি, সেটি তখন বাকে-বাজার নামেই পরিচিত ছিল। মূলত নিম্নবর্গীয় মানুষের বসবাস ছিল এখানে। পরে কোনো একজন নবাব তার অভিযানের সময় সৈন্যসামন্ত নিয়ে এখানে মাসখানেক আস্তানা গেড়েছিলেন, সেখান থেকে নাম হয় নবাবগঞ্জ। এই অঞ্চলেই বসতি স্থাপন করেন মন্ডলরা। প্রথমদিকে কৃষির ওপর নির্ভরশীল হলেও, পরবর্তীকালে তারা ব্যবসায়ের দিকেও মনোনিবেশ করেন। 


মন্ডল পরিবারের সমৃদ্ধি ঘটে মূলত শ্রীধর মন্ডল এবং বংশীধর মন্ডলের হাত ধরে। এনারা মশলা এবং নুনের ব্যাবসা করে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। বাড়ির পাশেই একটি ঘাট তৈরী করেন নদীপথে নিজেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য, যে ঘাটটি আজও মন্ডল ঘাট নামে বিখ্যাত। 

মন্ডল পরিবারের পুজোর ইতিহাস বলতে গেলে, এদের পুজোটা শুরু হয়েছিল ধান্য লক্ষ্মীপুজো দিয়ে। মন্ডলের পূর্বপুরুষ শ্রী রাজগোপাল মন্ডল শুরু করেছিলেন এই লক্ষ্মীপুজো। প্রায় ২৫০ বছর আগে, লক্ষ্মীপুজোর পাশাপাশি দুর্গাপুজো শুরু করেন শ্রী রসময় মন্ডল। প্রথম ১৭ বছর প্রতিমা ছাড়াই, ঘটে পুজো হতে থাকে। তারপর প্রতিমা পুজোর প্রচলন শুরু হয়। মন্ডলরা যেহেতু বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তাই এই বাড়িতে দেবীর হরগৌরী রূপের পুজো করা হয়। তাই এখানে অসুর, সিংহ, সাপ বা মহিষের কোনো মূর্তি দেখা যায় না। 

এবার আসা যাক পুজোর পদ্ধতিতে। মহালয়ার পরের দিন, দেবীপক্ষের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে, বাড়ির পূর্বদিকের ঘরের বেদীতে দুর্গা ঘট এবং লক্ষী ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়। নারায়ণ-শিলাকেও দুর্গামণ্ডপে নিয়ে আসা হয় নিয়মিত পুজো করার জন্য। এসবের জন্য পুরোহিতমশাই মহালয়ার দিনই এসেই সব ব্যাবস্থা করে দিয়ে যান, এবং এই নিত্যপুজো চলতে থাকে ষষ্ঠীর সকাল পর্যন্ত। 

রথযাত্রার দিন থেকে শুরু হয় একচালা প্রতিমা নির্মাণের কাজ। এর জন্য একটা নতুন বাঁশের ফ্রেম এনে, তাকে পুজো করে, সেখানেই খড় বাঁধার কাজ শুরু করা হয়। মূর্তি তৈরীর কাজ শেষ হলে, চালচিত্র আঁকা শুরু করা হয়, যাতে পরিবারের সদস্যরাও অংশগ্রহণ করেন। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় হয় বোধন, এবং সূচনার প্রতীক হিসেবে প্রতিমার দুই পাশে একটি ঘিয়ের এবং একটি তেলের প্রদীপ জ্বালানো হয়; যা জ্বলবে দশমীর সকাল পর্যন্ত। এই বাড়ির একটি বিশেষ নিয়ম হলো, পরিবারের কোনো একজন গৃহবধূ পুজোর সমস্ত ধর্মীয় আচারের দায়িত্ব নেন। দশমীতে সব নিয়ম মেনে, সামনে মন্ডল ঘাট থেকেই নৌকায় প্রতিমাকে তুলে নিয়ে, বাড়ির সদস্যরা মাঝ নদীতে বিসর্জন দেন। 

পুজোটি বর্তমানে ট্রাস্টের দ্বারা পরিচালিত হয়। যেখানে পুজোদালান, সেই অংশে কোনো পরিবারের সদস্য বসবাস করেন না। সেখানে আছে ঠাকুরের জন্য ভোগ রান্নার ঘর, ভাঁড়ার ঘর, ভোগ খাওয়ানোর ঘর এবং পরিচারকদের থাকার ঘর। ঠাকুরদালানের সাদা কালো মার্বেলে বাঁধানো উঠোনে রয়েছে ইউরোপিয়ান নারীমূর্তির হাতে আলোর ব্যাবস্থা, যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। 

এই বাড়ির পুজো দেখতে হলে, শিয়ালদা থেকে যেকোনো নদীয়া জেলা অভিমুখী লোকাল ট্রেনে নামতে হবে ইছাপুর স্টেশন। স্টেশনের বাইরে থেকে auto/toto তে বলতে হবে মন্ডল-ঘাট যাবো, যেখানে দুর্গাপুজো হয়। বাড়ির ঠিক পাশেই আপনাকে নামিয়ে দেবে। 

এই লেখাটির জন্য তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে, আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই শ্রীমতি প্রতীতি ঘোষকে এবং স্যার কমল ব্যানার্জীকে। 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)