বাবু সুবল চাঁদ চন্দ্র বাড়ির দুর্গাপুজো, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট (Baboo Subol Chand Chunder House's Durgapuja, Bechu Chatterjee Street)

সমগ্র কলকাতা জুড়ে অনেক বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো আমরা দেখতে যাই, তাদের সাবেকিয়ানা দেখে মুগ্ধ হই। এই সব পুজোগুলোর মধ্যে আমার একদম ব্যতিক্রমী লেগেছে, উত্তর কলকাতার বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রীটে অবস্থিত বাবু সুবল চাঁদ চন্দ্র দের ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো। চন্দ্র পরিবারের দুর্গা প্রতিমা, বাংলা জুড়ে পূজা করা বাকি মূর্তিগুলির থেকে একেবারেই আলাদা। এটি পরিবারের বৈষ্ণব শিকড়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে দেবীর শিব-দুর্গা রূপের পূজা করা হয়। এখানে, দেবী দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতে দেখা যায়। দেবী এখানে অভয়া রূপে বিরাজমান হন, যা শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক।

এবার এই পুজোর ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া যাক। পূজোর সূত্রপাত করেছিলেন চন্দ্র পরিবারের পূর্বপুরুষ শ্রী রাম প্রসাদ চন্দ্র। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে চন্দ্র পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু হয়। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে এই পরিবারের উত্তরপুরুষ বিশিষ্ট শিল্পপতি বাবু সুবল চাঁদ চন্দ্র, পুজোটিকে ঝামাপুকুর অঞ্চলের একটি বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাবু সুবল চাঁদ চন্দ্রর মূল ব্যবসা ছিল কাপড় এবং পাটের। ম্যানচেস্টার এবং বার্মিংহামে তার কাপড়ের মিল ছিল। তিনি ছিলেন বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের একজন বিশিষ্ট সদস্য। সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রম, দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য ছাত্র হোস্টেল পরিচালনা এবং পদাবলি কীর্তনের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান ছিল। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অন্যতম। কথিত আছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার সময়ে এসে দেবী দুর্গার পূজা করতেন।

এবার আসি এই পরিবারের পুজোর রীতিনীতির বিষয়ে। এখানে পুজোর সময় পশু বলি নিষিদ্ধ। অষ্টমীতে এখানে পরিবারের মহিলারা ধুনো-পোড়ানোর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানে উপোস রেখে, তিনটি মাটির থালা নিয়ে বসে (মাথায় এবং দুই পায়ে) সেখানে আগুন জ্বালানো হয়। এছাড়াও সন্ধিপূজার সময় ১০৮টি মাটির প্রদীপ, কলা পাতার সরু স্ট্রিপের ক্রসক্রস করা প্যাটার্নের উপর খুব সুন্দর করে সাজিয়ে জ্বালানো হয়, যেটা চমৎকার দেখতে লাগে! নবমী তিথিতে একটি সংকল্পের পরে অর্থের প্রতীকী বণ্টন করা হয়, যাকে "দক্ষিনান্ত" বলা হয়। নীলকণ্ঠ পাখির ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত, দশমীতে এই বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর একটি প্রথা ছিল। 

আজ অবধি পরিবারের সদস্যরা, শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং রীতিনীতিগুলি যতটা সম্ভব পালন করার চেষ্টা করেন। পুজোর দিনগুলোতে পরিবারের পুরুষেরা পরেন চেলি, ঐতিহ্যবাহী রেশমি ধুতি এবং চাদর; নারীরা গয়না হিসেবে পরেন নথ এবং মাওল। দেবীকে যে ভোগ নিবেদন করা হয়, সেখানেও রয়েছে বৈচিত্র্য। ভোগ তৈরির সময় কোনোপ্রকার লবণ ব্যবহার করা হয় না, এবং চিনির শিরায় ডুবানো কোনো মিষ্টিও দেবীর উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। দশমীতে বিসর্জনের পরে প্রায় সব বনেদি বাড়িতে যে সিঁদুর খেলা হয়, সেটাও এখানে নিষিদ্ধ। 

তথ্য সহায়তা: চন্দ্র পরিবার

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)