রাধা গোবিন্দ কুঞ্জ মন্দির : গিরিবালা দাসীর ঠাকুরবাড়ি, আগরপাড়া (Radha Govinda Kunja Temple : Giribala Dasi Thakurbari, Agarpara)

বি টি রোডের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হুগলি নদী। এর দুই তীরে গড়ে উঠেছে বহু মন্দির। দক্ষিণেশ্বর থেকে  ব্যারাকপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে সেই মন্দিরগুলো। এর মধ্যে আগরপাড়া-সোদপুর-পানিহাটি অঞ্চলে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির, যে মধ্যে কিছু কিছু হেরিটেজ তকমা পেলেও, অনেক মন্দির লাইমলাইটে আসে নি। সেগুলোর মধ্যেই একটা নিয়ে বলবো আজকে। 

আগরপাড়া অঞ্চলে, নদীর তীরে রয়েছে একটি সুপ্রাচীন ঠাকুরবাড়ি... যার সাথে জড়িয়ে আছে গিরিবালা দাসীর নাম। রাণী রাসমণির জ্যেষ্ঠা কন্যা পদ্মামণির নাত-বৌ ছিলেন গিরিবালা দাসী। তিনি ছিলেন রূপে লক্ষ্মী, গুণে অসামান্যা। অকালে তাঁর তিন পুত্র এবং স্বামী গোপালকৃষ্ণ গত হবার পরে, অন্তরের শোক-তাপ নিয়েই তিনি সৎকার্য্যে মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রাতস্মরণীয়া দিদি-শাশুড়ী রাণী রাসমণির পদাঙ্ক অনুসরণ করে, ১৩১৮ বঙ্গাব্দে ১৮ই জ্যৈষ্ঠ (১লা জুন ১৯১১ ইং) বৃহস্পতিবার তিনি এই ঠাকুরবাড়ি পত্তন করেন। এর নাম তিনি রাখেন 'রাধা গোবিন্দ কুঞ্জ মন্দির'।

এই ঠাকুরবাড়ি তৈরী করতে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। স্থপতি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার গগনচন্দ্র বিশ্বাস এবং এস এম ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছর বাদে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এবার আসা যাক মন্দিরের বর্ণনায়। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই সামনে পড়বে একটা বৃহৎ কারুকার্যময় নাটমন্দির, যেখানে লতা, গুল্ম, পাতা দিয়ে খুব সূক্ষ্ম বিভিন্ন শিল্পকলার কাজ দেখা যায়। এছাড়াও রয়েছে নহবতখানা। দুটি নহবতখানা ছিল, একটি রয়েছে। আরেকটি ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে তৈরি হচ্ছে।

মন্দির প্রাঙ্গণটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মূল মন্দিরটিতে প্রধান পূজিত হচ্ছেন রাধাগোবিন্দ, কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ ও অষ্টধাতুর রাধা। এদের সাথেই রয়েছে গণেশ, নারায়ণ শিলা, অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি এবং গিরিবালা দেবীর জপ রতা পিতলের মূর্তি। 


পঞ্চরত্ন মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, এবং ৭ ফুট উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশপথের সিঁড়ির দুপাশে রয়েছে, বাতিদান হাতে পাথরের দুই নারীমূর্তি। রয়েছে পঙ্খের অপূর্ব কারুকাজ, যেখানে চারদিকে বাঁশির ছাপ দেখা যায়। একেদিকে হাঙরের মাথা আর প্রত্যেক দিকে দুটো করে বাঁশির আদল।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির কমপ্লেক্সের মতো এই মন্দিরেও একটি সুন্দর গঙ্গার ঘাট রয়েছে, যেখানে যাওয়ার জন্যে রয়েছে চাঁদনি দালান (মন্দির থেকে গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার রাস্তা)। 

নাটমন্দিরের দুই পাশে প্রায় ৬ ফিট উঁচু বেদীতে, তিনটি তিনটি করে মোট ছয়টি শিবমন্দির রয়েছে। দক্ষিণদিকে প্রথম মন্দিরটি রামেশ্বর, দ্বিতীয়টি রাজেশ্বর এবং তৃতীয়টি গোপেশ্বর। উত্তরদিকে প্রথম মন্দিরটি তারকেশ্বর, দ্বিতীয়টি ভুবনেশ্বর ও তৃতীয়টি গিরিশ্বর শিব। সবকটি শিব মন্দিরেই সামনে ও পিছনে রয়েছে অপূর্ব পঙ্খের ভাস্কর্য। 

রামেশ্বর মন্দিরের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারের উপর রয়েছে 'যুগলমিলন মূর্তি'। পশ্চিমদিকের দরজার উপর রয়েছে 'কৃষ্ণ বলরাম মূর্তি'। রাজেশ্বর শিব মন্দিরটির পশ্চিম দরজার উপরে রয়েছে 'রাম রাজার মূর্তি', মূর্তিতে রামসীতার আসনের নীচে দুইটি বাঁদর বসে আছে। গোপেশ্বর শিবের মন্দিরের পূর্বদিকের দরজায় রয়েছে 'রাই রাজার মূর্তি'। মূর্তিতে পদ্মাসনে বসে থাকা রাধার দুদিকে দুইজন করে সখীর মূর্তি রয়েছে, পশ্চিমের দরজার উপরে রয়েছে 'শিবের বিবাহ' দৃশ্য। সেখানে বলদের পিঠে হরপার্বতী ছাড়াও একজন শিঙ্গাবাদক ও একজন শঙ্খবাদক রয়েছেন। তাঁরকেশ্বর শিব মন্দিরের পিছনে রয়েছে 'মার্কণ্ডেয় উদ্ধার মূর্তি'। ভুবনেশ্বর শিব মন্দিরের পেছনে রয়েছে 'অন্নপূর্ণা'। গিরিশ্বর শিবমন্দিরের উত্তরপাশে রয়েছে 'প্রতীক্ষামাণা', আর পিছনে 'হরহরি মিলন' এর মতো অনেক পৌরাণিক অনুষ্ঠানের নকশা। একটা বিষয় যেটা আমার উল্লেখযোগ্য লাগলো, সেটা হলো শিব মন্দিরে কৃষ্ণের লীলা বর্ণিত হয়েছে, যেটা সাধারণত দেখা যায় না। 

মূল মন্দিরের পূর্বদিকের ঘরগুলোতে আছে অফিস, রান্না ও ভাঁড়ার ঘর, এবং সেবকদের থাকার জায়গা। গিরিবালা দেবীর উত্তরসূরিদের ইচ্ছায় ১৯৮৫ সালের ২৩ জানুয়ারি, মহামণ্ডলেশ্বর শ্রী শ্রী শিবানন্দ গিরি মহারাজের তত্ত্বাবধানে হরিদ্বারের ভোলানন্দ সন্ন্যাস আশ্রম এই মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এখন গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি ভোলাগিরি স্নেহনীড় নামেও পরিচিত। শিবানন্দ নিজ উদ্যোগে এই মন্দিরের প্রথম সংস্কার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মন্দিরের রাধারানির মূর্তিটি শিবানন্দ প্রতিষ্ঠিত। গিরিবালা প্রতিষ্ঠিত মূর্তিটি চুরি গিয়েছিল। পরে একটি শ্বেত পাথরের মূর্তি পূজিত হত, যা অসাবধানতাবশত ভেঙে যায়। পরে শিবানন্দ গিরি বৃন্দাবন থেকে অষ্টধাতুর রাধারানির মূর্তি গড়িয়ে নিয়ে আসেন।


মন্দির চত্বরে ঢোকার আগে, একটা ভগ্নপ্রায় দালাম বাড়ি চোখে পড়ে। কিন্তু খোঁজ খবর করে এই বাড়ির সম্পর্কে খুব একটা বিস্তৃত আমি জানতে পারি নি। মন্দির কর্তৃপক্ষ এটাই বললেন, যে এটিও গিরিবালা দাসীর পরিবারের সম্পত্তি। বাড়িটির চারদিকে আছে মাঠ, সেখানে স্থানীয় ছেলেরা ফুটবল খেলে। 


২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রাধাগোবিন্দ কুঞ্জ অর্থাৎ গিরিবালা ঠাকুরবাড়িকে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এখানে দিনে নিত্যভোগ হয়, অন্নভোগ। দিনে চার- পাঁচবার পুজো হয়। সারা বছর উৎসব হয়, মন্দিরে প্রতিষ্ঠা উৎসব, রথ, রাধাষ্টমী, জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, ঝুলন, রাসযাত্রা, নীলষষ্ঠী, শিবরাত্রি ইত্যাদি পালিত হয়। আশা করা যায়, মন্দিরটি আগরপাড়া অঞ্চলে চিরকাল তার স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবে। 

তথ্যসূত্র ও সহায়তা: শ্রী শেখর শেঠ এবং মন্দির কর্তৃপক্ষ। 

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)