সুরিনাম ঘাট ও মেমোরিয়াল, মেটিয়াবুরুজ : ইতিহাসের একটা হারানো অধ্যায় (Suriname Ghat & Memorial, Metiaburz : A Forgotten History)
মেটিয়াবুরুজের খ্যাতি মূলত নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের জন্য। কিন্তু খুব কম মানুষ জানেন, এই এলাকার মাটি একসময় ভিজেছে নিরীহ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের চোখের জলে, যাদের নিরুপায় হয়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে।
এখানকার CESC Southern Generating Station এর মধ্যে দিয়ে একটা খুব পুরোনো ঘাটে যাওয়া যায় (পারমিশন করিয়ে নিতে হয় CESC গেটে)। এই ঘাটটি এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে 'বালু ঘাট' নামেই পরিচিত। ঘাটটি প্রচারের আলোয় উঠে আসে ২০১৫ সালে। ওই বছরের ৭ই অক্টোবর, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আসেন মেটিয়াবুরুজের বালুঘাট তথা সুরিনাম ঘাটে। সুরিনাম ও ভারতের স্মৃতি বিজড়িত অ্যালুমিনিয়ামের মাই বাপ মূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন। আমরা এই ব্লগে জেনে নেব, সেই লাঞ্ছনার ইতিহাস। কিন্তু সেটার সম্পর্কে জানতে হলে, আমাদের আগে জানতে হবে সুরিনাম সম্পর্কে।
সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশের নাম হলো সুরিনাম। মূলতঃ কৃষি নির্ভর এই দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজ বণিকেরা সুরিনামের (পূর্বতন নাম ওলন্দাজ গায়ানা) উপকূলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। পরের শতকেই আবার ইংরেজরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। আবার সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজ বণিকেরা ১৬৫০ সাল নাগাদ সুরিনাম নদীর তীরে একটি পাকাপাকি ব্রিটিশ বসতি স্থাপিত হয়, যদিও পরবর্তীকালে সেই বসতি দখল করে নেয় ডাচরা। ১৬৬৭ সালে ব্রেডার চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজরা উত্তর আমেরিকায় নিউ অ্যামস্টার্ডাম (বর্তমান নিউ ইয়র্ক শহরে)-এর বিনিময়ে এই উপনিবেশটির একাংশ ডাচদের দিয়ে দেয়। এর ফলে সুরিনাম সরকারীভাবে একটি ডাচ উপনিবেশ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় উঠে আসে। অনেক টানাপোড়েন পেরিয়ে, ১৯৭৫ সালের ২৫শে নভেম্বর সুরিনাম স্বাধীনতা লাভ করে ডাচদের কাছ থেকে।
সুরিনামে ডাচ উপনিবেশের অর্থনীতির প্রাথমিক ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ, যার জন্য আফ্রিকা থেকে বিরাট সংখ্যক ক্রীতদাসদের এখানে চাষের জন্য নিয়ে আসা হতো। এখানে প্রধান শস্য আখ হলেও, অনেক জায়গায় কফি, নীল, তুলা, খাদ্যশস্য ও কাঠ উৎপাদনী বৃক্ষও চাষ করা হতো। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত সেদেশে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যথেষ্ঠ প্রসার লাভ করে। সেসময় এখানে ৫৯১টি কৃষি খামার ছিল, যাদের মধ্যে ৪৫২টি চিনি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শস্য উৎপাদন করত, এবং ১৩৯টি খাদ্যশস্য ও কাঠ উৎপাদন করত। ১৭৮৫ সালের পর কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে।
সুরিনামের দাসপ্রথা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। ঔপনিবেশিক আইন অনুসারে দাসদের মালিকদের ছিল সর্বময় একচ্ছত্র ক্ষমতা। এদের সম্পত্তির মত ব্যবহার করা হত, এবং তাদের কোন আইনি অধিকার ছিল না। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইংরেজ ও ফরাসিরা আইন করে তাদের দাসদের মুক্তির ব্যবস্থা করে। তখন ডাচেরাও তাদের উপনিবেশগুলিতে দাসদের মুক্তির বিষয়ে তৎপর হয়। সুরিনামের খামারের মালিকদের ভীতি ছিল যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেরা আর খামারের কাজ করতে চাইবে না। তাই সেখানে আইন করে, মুক্তির পরেও ১০ বছর ন্যূনতম ভাড়ায় সরকারী নির্দেশনায় দাসদের খামারে কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু ১৮৬৩ সালে পূর্ণ মুক্তির পর প্রাক্তন দাসেরা ভাল বেতনের চাকরি ও উন্নত শিক্ষার আশায় পারম্যারিবো (সুরিনামের রাজধানী) শহরে ভিড় জমাতে থাকে।
এই স্থানান্তরের ফলে সুরিনামের খামারগুলিতে কর্মীর যে অভাব দেখা দেয়, তা পূরণ করতে এশিয়া থেকে শ্রমিক আমদানি শুরু হয়। এই শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের জন্য খামারে মূলত কৃষিকাজের জন্য, প্রতিশ্রুতি সংবলিত চুক্তি স্বাক্ষর করে এখানে কাজ করতে আসতো। ডাচেরা ব্রিটিশদের সাথে নেদারল্যান্ডের হগ শহরে এই কারণে একটি চুক্তি করে ৮ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে। চুক্তি অনুসারে ডাচ গায়ানা ব্রিটিশদের হতে ছেড়ে দিল ডাচরা, পরিবর্তে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষ থেকে শ্রমিক নিয়োগের অধিকার পেল।
এরপর থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিভিন্ন দেশ থেকে ডাচেরা চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক সুরিনামে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। অবিভক্ত ভারতবর্ষ তখন স্বল্প মজুরিতে সুলভ শ্রমিক জোগাড় করার স্বর্গরাজ্য। সারা ভারত জুড়ে গড়ে উঠলো এজেন্সি, কলকাতায় তৈরি হল মরিশাস, দক্ষিণ গায়ানা বা সুরিনামের অফিস। এজেন্টরা ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, বাংলা ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নিয়োগ করা শুরু করল।
কলকাতা থেকে বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে যে নির্দিষ্ট জেটি থেকে জাহাজ যাত্রা করত, গন্তব্য দেশটার নামেই জেটির নামকরণ হত। এইভাবেই সুরিনাম ঘাট নাম হয়। সুরিনামের উদ্দেশ্যে যে প্রথম জাহাজটি কলকাতা থেকে পাড়ি জমায়, তার নাম ছিল 'আল্লারুখ'। এটি গাদাগাদি করে ৩৯৯ জন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩। ৫ই জুন 'আল্লারুখ' যখন সুরিনামের রাজধানী পারামারিবোতে পদার্পণ করে, তখন আগত শ্রমিকদের ১১ জন যাত্রার ক্লান্তি এবং ভিড়ের চাপে মারা যান। ১৯১৪ সালে ভারত থেকে রওনা দেওয়া যে জাহাজ শেষ সুরিনামে পৌঁছেছিল, তার নাম ছিল 'দেয়া'।
১৮৭৩ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে ৬৪টি জাহাজ ৩৪,০০০-এর বেশি শ্রমিক নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল সুরিনামের পথে। সেই সময়ে কর আদায়ের কড়াকড়ি, অত্যাচার ভারতীয় কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিয়েছিল। বছরের যে সময়ে চাষবাস হত না, সেইসময় বিকল্প জীবিকা না থাকায় তাদের অর্ধাহারে, অনাহারে জীবন কাটাতে হত। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাদের অনেকেই সরল মনে পাঁচ বছরের জন্য সুরিনাম যাওয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। এর পরিণাম তাদের জানা ছিল না। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে মুজফফরপুর, বেনারস, এলাহাবাদ, পাটনা,ভাগলপুর অঞ্চলে নিয়ে আসা হত, সেখান থেকে রেলে কলকাতায়। কলকাতায় আসার পর শ্রমিকদের বরাদ্দ ছিল থালা, বাটি আর কয়েকখানা পোশাক। এই নিয়ে পুঁটুলি বেঁধে তাদের যাত্রা শুরু হত। যদিও ব্রিটিশ সরকার তাদের বোঝাত পাঁচ বছর পরে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সেই আশাতেই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে যাত্রা করত, কিন্তু আসলে ডাচদের কাছে একরকম দাস হিসেবেই হস্তান্তরিত হতো। এছাড়াও শুধুমাত্র পেটের টানে বলা ভুল হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাকুতি মিনতি, লোভ, ভয় দেখিয়ে দৈহিক নির্যাতন করা, জোর খাটানো – সবরকম উপায়েই তাঁরা শ্রমিক সংগ্রহ করতেন। পুরুষ শ্রমিকের জোগান দিয়ে এজেন্ট পেতেন ২৫ টাকা আর মহিলা শ্রমিকের জোগানে ধার্য ছিল ৩৫ টাকা।
কথা ছিল পাঁচ বছর পরে কাজ শেষে ঘরে ফিরে আসবেন তাঁরা, কিন্তু তা হয়নি। ক্রমশ ব্যাপারটা নির্বাসন হয়ে দাঁড়াল। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের আর ফিরিয়ে আনেনি। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল মানুষগুলোকে। এভাবেই, শেষপর্যন্ত ও দেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন সেই শ্রমিকরা। একবার সুরিনাম ছেড়ে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন কেউ কেউ চলে গিয়েছিলেন, অনেকে যাননি। দেশ, আত্মীয় পরিজন শুধু স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছিল। সুরিনাম ঘাটের এই মাই বাপ ফলকটি সুরিনামের পারামারিবোয় স্থাপিত মূর্তির রেপ্লিকা — মা, বাবা, সন্তানের হাত ধরে, পুঁটলি নিয়ে মানুষ চলেছে অজানিতের পথে। সেই সুরিনাম যাত্রার স্মৃতি এখন বেঁচে আছে উত্তরসূরিদের মধ্যে।
মাই বাপ স্মৃতিফলকটির আবরণ উন্মোচনে সুরিনাম ঘাটে এসেছিলেন ভারতে সুরিনামের রাষ্ট্রদূত আসনা কানহাই, যিনি নিজেও ভারতীয় বংশোদ্ভুত। তিনি আবেগবিহ্বল হয়ে স্মৃতিচারণ করেন কীভাবে তাঁর পূর্বপুরুষ ভবানীপুর ডিপো থেকে সুরিনাম যাত্রা করেছিলেন। ছোটবেলায় সুরিনামে শোনা ভোজপুরী গান, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী, কোরান পাঠ আর কিছু রবীন্দ্রসংগীতের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
সুরিনাম ঘাট আজ পরিত্যক্ত। কোনো জাহাজ আনাগোনা করে না। অব্যক্ত যন্ত্রণার ও প্রতারণার স্মৃতিভার বুকে নিয়ে, এক বিস্মৃত ইতিহাসের সাক্ষী এই সুরিনাম ঘাট তাই বোধহয় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাবে।
ফুটনোট: আমি এই ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারতাম না, যদি না আমার বন্ধু অর্ণব ঘোষ দস্তিদার আমাকে নিয়ে যেতো।
তথ্যসূত্র:
১. peepultree.world/livehistoryindia/story/living-culture/suriname-ghat-tracing-the-journey-of-suriname-indians
২. thehindu.com/news/national/other-states/finally-a-memorial-for-indentured-labours-at-kolkata-ghat/article20928693.ece
৩. indianexpress.com/article/cities/kolkata/in-honour-of-labourers-who-left-for-suriname-a-memorial-to-baba-mai/
Comments
Post a Comment