আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারাথ, কোলকাতা (Armenian Church of the Holy Nazareth, Kolkata)
মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যান দেখলে বেশ চমৎকার লাগে তো? ঘিঞ্জি বড়োবাজারের গলিগুলোর মধ্যে থেকে, হঠাৎ করে এই গির্জাটার মধ্যে ঢুকলে আপনার সেইরকম অনুভূতি হবে! প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, কোলকাতার প্রাচীনতম গির্জা এটা। আজকে যেখানে গড়ে উঠেছে এই চার্চ, সেটা ছিল আদপে আর্মানীদের সমাধিক্ষেত্র।
কোলকাতায় আর্মেনিয়ানদের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ১৬৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সুরাটের এক আর্মানী বণিক খোজা ফানুস কালান্টর, আরেক ব্যবসায়ী ও তার ভাগ্নে খোজা ইসরায়েল সরহদকে সাথে নিয়ে, ইংল্যান্ডে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডের চেয়ারম্যান জোসিয়া চাইল্ডের সাথে দেখা করেন। এখানে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার সাহায্যে আর্মানীরা ভারতে ব্যবসার ও ধর্মচর্চার কিছু সুবিধা পায়।
“Whenever forty or more of the Armenian nation shall become inhabitants in any of the garrisons, cities, or towns, belonging to the Company in the East Indies, the said Armenians shall not only have and enjoy the free use and exercise of their religion, but there shall also be allotted to them a parcel of ground to erect a church thereon…."
এই চুক্তি অনুযায়ী, বড়ো বাজার অঞ্চলে নিজেদের সমাধিভূমির এক পাশে তারা গড়ে তোলেন একটা সাময়িক কাঠের প্রার্থনাগৃহ। এই গির্জার প্রতিষ্ঠাকাল যে কবে, সেটা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। গির্জার প্রধান ফটকের পাশে লেখা আছে ১৭০৭ খৃস্টাব্দে এর স্থাপনা হয়।
আমার ধারণা, ১৬৮৮-৭০ নাগাদ এই কাঠের প্রার্থনাগৃহটি তৈরী হয়েছিল। পরে ১৭০৭ সালে সেই গৃহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, এবং সেই বছরই বর্তমান গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, যার কাজ শেষ হয় ১৭২৪ খৃস্টাব্দে। আগা নাজার নামের এক আর্মানী বণিক এটি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নেন, এবং তারই সম্মানে এই গির্জার নাম রাখা হয় আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারাথ।
এই প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য পাওয়া যায় ২৫.০৩.১৮০২ তারিখে লেখা Arakial Moses Chatchicks নামের এক আর্মানী ভদ্রলোকের চিঠি থেকে।
"The Armenian Church was build in the year 1724 by one Aga Nazar and the Steeple was added in 1734 by one Mannae Hazaar Mall (এই কিন্তু সেই হুজুরিমল, যাকে সাধারণত শিখ ভাবা হয়), the expenses attending which was defrayed with a sum appropriated for the purpose by his father Hazaar Mall Chatoor. The Architect Gavond was an Armenian from Persia. No material alteration was made in the Armenian Church from the above period until the year 1790, when my deceased father Catchik Arakial embellished the church inside, presented the clock, added the houses for the clergy and built the surrounding walls. The church now goes by the name of Saint Nazareth's Church in honour of the founder."
এবার আসা যাক চার্চ কম্পাউন্ডার বর্ণনায়। সারা কম্পাউন্ড জুড়েই ছড়িয়ে আছে কবরের এপিটাফ, আর কয়েকটা কবরের ওপরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে কোলকাতার প্রাচীনতম কবর, মিসেস রেজা বিবির। ফলকের লেখা আর্মানী ভাষায় হবার জন্য, এখন এর উপরে একটা আলাদা ফলকে ইংরেজিতে লেখা আছে...
"This is the tomb of
Rezabeebeh
Wife of the Late Charitable Sookias
Who departed from
This World to
Life Eternal
On the 11 th July, 1630"
এই ইংরেজি অনুবাদটি ঊনবিংশ শতকের করেছিলেন বিখ্যাত আর্মেনিয়ান ঐতিহাসিক এবং লেখক Mesrovb Jacob Seth। এবার এই সালটি কতোটা ঠিক, সেই নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে, সেই বিষয়ে আমি একটা অন্য ব্লগে আলোচনা করবো।
এই প্রসঙ্গে বলি, এরাই হলো সেই সুকিয়া পরিবার, যাদের নামে কোলকাতায় আছে সুকিয়া স্ট্রীট।
এবার আসি চার্চের অন্দরসজ্জার বিষয়ে। ছবি তোলার অনুমতি পাই নি এখানে। ভিতরে আসবাব অনেক পুরোনো হলেও, খুবই যত্ন করে রাখা সব কিছু। অর্থোডক্স এই গির্জার বেদির পিছনের দিকে বিরাট একটা অয়েল পেন্টিংয়ে আছে 'The Last Supper' ছবিটি, আর তার নিচে আছে 'এনশরাউডিং অফ আওয়ার লর্ড' ছবিটা। এছাড়াও আছে 'The Holy Trinity' ছবিটি। তিনটে ছবিই বিখ্যাত ইংরেজ চিত্রশিল্পী এ.ই. হেরিসের আঁকা।
এবার একটা অন্যরকম তথ্য দি। এখানে খ্রিস্টমাস পালন হয় ৬ই জানুয়ারিতে! এর কারণ হলো, ফোর্থ সেঞ্চুরি পর্যন্ত যীশুর জন্মদিন পালিত হতো এই দিনেই! কিন্তু রোমানরা পরবর্তীকালে কিছু বিশেষ কারণে এই তারিখ বদলে ২৫শে ডিসেম্বর করে দেয়। সারা পৃথিবীর খ্রিস্টীয়ানরা এই পরিবর্তিত তারিখ পালন করলেও, আর্মেনিয়ানরা আসল তারিখটাই উদযাপন করেন।
তথ্য সূত্র:
১. Life and Adventures of Emin Joseph Emin, 1726-1809, Joseph Emin, Wentworth Press
২. কলকাতার উপাসনালয়, দ্বিতীয় খন্ড, পীযূষকান্তি রায়
৩. কলকাতার প্রতিবেশী, পীযূষকান্তি রায়
Comments
Post a Comment