মেটিয়াবুরুজের রাজকাহিনী : নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ এবং সিবতৈনবাদ ইমামবাড়া (The Royal Story of Metiaburz : Nawab Wajid Ali Shah & Sibtainbad Imambara)
খিদিরপুরের কলকাতা বন্দরের লাগোয়া অঞ্চল হলো মেটিয়াবুরুজ। এখানেও আছে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট জেটি, যেখানে ছোট সাইজের জাহাজ বা বড়ো মালবাহী বজরা নোঙর করতে পারে। এই অঞ্চলের আরেক নাম গার্ডেন রিচ। বর্তমানে এই অঞ্চলটি একটি ঘিঞ্জি এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ অধ্যুষিত অঞ্চল। বন্দরের নিকটবর্তী হবার কারণে, এখানে অপরাধমূলক কাজের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে, মেটিয়াবুরুজের ঠিক উল্টোদিকে হুগলি নদীর ওপারে আছে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন।
অঞ্চলটির মেটিয়াবুরুজ নামের নেপথ্যে রয়েছে একটা মাটির দূর্গ, যেটা ছিল এখানেই নদীর পাড়ে। এই জায়গাতেই হুগলি নদী একটা বাঁক নিয়েছে। কালের প্রবাহে বিভিন্ন ঘটনাক্রমে, সেই দূর্গ ধ্বংস হয়ে গেলেও, সেই স্মৃতি রয়ে যায় এলাকার নামে। এরপরে বন্দর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইউরোপিয়ানদের বাড়ি তৈরির সময়, প্রত্যেকেই বেশ বড়ো জায়গা নিয়ে বাগানবাড়ি বানান। সেই কারণেই অঞ্চলটির নাম পরবর্তীকালে গার্ডেন রিচ দেওয়া হয়, যদিও এখন সেসব বাড়িরও বিশেষ অস্তিত্ব নেই।
কোলকাতার মধ্যে অবস্থিত ইমামবাড়াগুলোর মধ্যে একটা বড়ো ইমামবাড়া রয়েছে এই অঞ্চলে। সেটার নাম হলো সিবতৈনবাদ ইমামবাড়া (Sibtainbad Imambara)। এটি লখনউ-এর বড়ো ইমামবাড়ার একটা ছোট প্রতিরূপ। এখানে সমাধিস্থ আছেন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ (Wajid Ali Shah), পুরো নাম আবুল মনসুর মীর্জা মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলি শাহ। ইনি লখনৌ থেকে নির্বাসিত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো এখানে কাটিয়েছিলেন। এই মেটিয়াবুরুজকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'ছোট লখনৌ' হিসেবে। সেই নিয়েই আজকে আমার এই ব্লগ।
গল্পটা শুরু হয় কলকাতার থেকে অনেক দূরে, তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অযোধ্যার লখনউতে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগ থেকেই, ইংরেজদের প্রতাপে ও অন্যান্য কারণে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যেমন একদিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠছিল, তার সাথে সাথেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুকৌশলে উত্তরাধিকারীহীন অথবা দুর্বল রাজাদের হাত থেকে তাদের রাজ্য কেড়ে নিচ্ছিল।
লখনউ তখন ছিল আওয়াধ (অযোধ্যা) - এর প্রাণকেন্দ্র এবং উত্তর ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সিংহাসনে বসলে লখনউ এক অভাবনীয় সমৃদ্ধি লাভ করে। নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায়, বিশেষত শিল্প ও কলাবিদ্যার চর্চা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। অবশ্য এই সুসময় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। স্বত্ববিলোপ নীতির মাধ্যমে, ঝাঁসি, উদয়পুর এবং আউধ-সহ প্রায় একুশটি রাজন্যবর্গ-শাসিত রাজ্য দখল করে নেয় কোম্পানি। ব্রিটিশদের দেওয়া সন্ধির শর্ত পছন্দ হয়নি আওধের নবাবের। শর্ত মানতে অস্বীকার করায়, ১৮৫৬-র ৪ঠা ফেব্রুয়ারি জেমস উট্রামের হাতে নিজের মাথার তাজ তুলে দিয়ে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ আত্মীয়স্বজন সমেত লখনউ ছেড়ে কলকাতার পথে জাহাজ নিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, বড়োলাটের সাথে দেখা করবেন, দরকার হলে ইংল্যান্ডের রানীর কাছেও তিনি আবেদন জানাবেন, উদ্ধার করবেন নিজের হৃতগৌরব।
এই প্রসঙ্গে নবাবের প্রধান বেগম হজরত মহলের বিষয়টা না তুললে, লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নবাবের নির্বাসন যাত্রায় বেগম সঙ্গী হননি, তিনি লখনউতেই থেকে যান। শোনা যায়, কলকাতা যাওয়ার আগেই নবাবের সঙ্গে বেগমের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি এক অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। নবাবের নির্বাসনের পরে নেতৃত্বের যে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল, সেটা পূরণ করেছিলেন বেগম হজরত মহল। তিনি ১৮৫৭ সালের জুন মাসে চোদ্দো বছরের শিশুপুত্র বিরজিস কদ্রকে (Birjis Qadr) আওয়াধের নবাব ঘোষণা করেন। সমাজের সর্ব স্তরে ইংরেজবিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ছোটবড় জমিদার, শাসক, এমনকি কৃষকদেরও সংগঠিত করে ইংরেজদের সমূলে ধ্বংস করার সঙ্কল্প করেন তিনি। গঠন করেন নিজের সৈন্যদল।
৩০ জুন ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে, লখনউ শহরের অদূরে যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী বেগম হজরত মহলের সৈন্যদলের হাতে নাস্তানাবুদ হয়। লখনউ ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত, এই ঘোষণা করা হয়। বেগমের অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের দৃষ্টান্ত তৎকালীন ইউরোপীয়দের নজর এড়ায়নি। উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত ‘মাই ইন্ডিয়ান মিউটিনি ডায়েরি’-তে লিখেছেন, ‘‘অভূতপূর্ব শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শন করেন বেগম। তিনি তাঁর ছেলের রাজ্য রক্ষার স্বার্থকে সর্বজনীন কর্তব্য হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি।’’ বেগমের স্বাধীনচেতা মানসিকতা দিল্লির দরবারের শেষ মুঘল সম্রাটের সম্ভ্রম ও স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল।
১৮৫৭ সালের শেষ দিকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। যে জায়গাগুলোয় বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, ইংরেজরা সেগুলো দখল করে নেয়। বিদ্রোহী সেনাদের মনোবল ভেঙে ফেলতে অকথ্য অত্যাচার শুরু করে কোম্পানি। তাই অদম্য চেষ্টা সত্ত্বেও হার মানতে হয় বেগমকে। পরাধীন ভাবে এ রাজ্যে জীবন কাটাতে চান না বলে, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে পুত্রসহ নেপালের কাঠমান্ডুতে আশ্রয় নেন তিনি। সেখানেই ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু হয় তাঁর, এবং ওখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
এরপরে আবার আমরা ফিরে আসি নবাবের বিষয়ে। ১৩ মে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে McLeod নামের একটা জাহাজে করে তিনি সমস্ত লোকজন নিয়ে পৌঁছলেন কলকাতা শহরে। খুব সম্ভবত মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলের বিচালী ঘাটেই লেগেছিল তার জাহাজ। একুশটি তোপধ্বনিতে সম্ভাষিত করা হলো তার কলকাতা আগমনকে। এবার কোলকাতায় থাকার জন্য ঠিক করে দেওয়া হলো, মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলের একটি সুদৃশ্য ইউরোপিয়ান ধাঁচের একটি বাড়ি, যার বর্তমান মালিকানা ছিল বর্ধমানের মহারাজ মহতাব চন্দ বাহাদুরের। সেটি মাসিক ৫০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে, ওয়াজিদ আলী আপাতত কলকাতায় থিতু হলেন।
কলকাতায় এসে প্রথমেই তিনি উদ্যোগী হলেন বড়োলাটের কাছে নিজের রাজত্ব ফিরে পাবার আবেদন জানাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ, নবাবের আবেদন এক কথায় খারিজ হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে নবাব দমে গেলেও, তিনি ইংল্যান্ডে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন করার মনস্থির করেন। কিন্ত তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য, নবাবের বৃদ্ধা মা মালিকা বেগম (জনাব-ই আলিয়া) ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন, সাথে নেন নবাবের আরেক ভাইকে।
১৮৫৭ সালের ১০ই মে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয় মেরঠ অঞ্চলে, এবং তা ছড়াতে থাকে ক্রমশঃ দিল্লির দিকে। এর মধ্যেই ১৩ই জুন ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতরে আব্দুল সুভান নামের একটি অল্পবয়সী ছেলেকে সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য গ্রেপ্তার করে হয়। তাকে জেরা করে জানা যায়, ওয়াজিদ আলী শাহ এবং বাহাদুর শাহ জাফর মিলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হচ্ছেন! আবদুল এখানে এসেছে, যাতে ফোর্ট উইলিয়ামে দরকার মতো আক্রমণ করার জায়গা খোঁজ যায়। এর ঠিক দুদিন পরেই, ৫০০ জনের একটি সেনাবাহিনী নিয়ে গার্ডেনরিচে এসে ওয়াজিদ আলীকে গ্রেফতার করে ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দী করা হয়। ওদিকে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছেও নবাবের মায়ের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর সাথে সাথেই, ওয়াজিদের আউধে ফিরে যাওয়া কিংবা রাজত্ব ফিরে পাওয়ার শেষ আশাটুকুও মুছে যায়।
২ রা আগস্ট ১৮৫৮ সালে, মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে মহাবিদ্রোহের অবসান ঘটলো। তার কয়েক মাস পরেই, ১৮৫৯-এর ৯ জুলাই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের কারাগার থেকে গার্ডেনরিচে ফিরলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এবার পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ঠাঁই হলো তার। নিজের প্রিয় শহরে আর ফিরতে পারবেন না বলে, কোলকাতার মেটিয়াবুরুজকেই লখনউ এর মতো করে সাজানোর মনস্থির করেন। ইংরেজদের থেকে বছরে ১২ লক্ষ টাকা পেনশনের ভিত্তিতে রফা হলো তার সাথে।
কলকাতায় এসে তিনি যে ভাড়ার বাড়িটিতে উঠেছিলেন, সেখানেই বানালেন নিজের সুলতানখানা। এরই সাথে, পাশের দুটো জমি ও ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের বাড়ি নবাব কিনে নিলেন সাকুল্যে তিন লাখ টাকায়। বাড়িগুলোকে বদলে নিয়েছিলেন ভারতীয় স্টাইলে, এবং পাশেই বানালেন নিজের নমাজের জন্য মসজিদ।
এই তিনটে বাড়িতে থাকতেন তার প্রায় ৩৭৫ জন স্ত্রী, ৫০ জন আফ্রিকার দাস, ২৪৫ জন 'বিশেষ রক্ষী’, ১২০ জন সশস্ত্র রক্ষী, ২০ জন দণ্ডবাহী, ১৮ জন খোজা। এ ছাড়াও ছিল কসাই, কামার, কুমোর, রসুইকর, জমাদার, ধোপা, নাপিত, ঘণ্টাপিটাই।
নবাবের প্রধানা স্ত্রী বা খাস মহলেরও একটা ছোট দরবার ছিল। সেখানে দর্জি, ধোপানি, ধাই, চাকরানি, হুকাবরদার, পঙ্খাওয়ালি, পানওয়ালি ছাড়াও ছিল গল্প শোনানোর মেয়েরা। অন্য বেগমদের বন্দোবস্তও কিছু কম যায় না। এসবের কারণে, বেগমদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো। এই অশান্তির কারণে অনেকে লখনউতে ফিরেও যেতেন, যার মধ্যে ১৮৫৯-এর শরতে প্রথম মেটিয়াবুরুজ ছাড়েন ছোটি বেগম... আর ওই একই বছরের ১৬ই নভেম্বর, ফোর্ট উইলিয়ামের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আহ্লাদে একই দিনে তিনটে নতুন বিয়েও করেন নবাব!
সঙ্গীত এবং নৃত্য প্রিয় নবাবের সঙ্গী ছিলেন অনেক আমির-ওমরাহ, পাইক-বরকন্দাজ, খিদমদগার। গাইয়ে-বাজিয়ে-নর্তকীদের সংখ্যাও তাজ্জব করা! এর সাথে ছিল নবাবের নিজস্ব চিড়িয়াখানা, যে চিড়িয়াখানার পিছনেই ওয়াজিদ আলি শাহের মাস গেলে খরচ হতো প্রায় নয় হাজার টাকা। কারণ হাজার হাজার পাখপাখালি ছাড়াও (শুধু পায়রাই ২৪ হাজার) সেখানে পোষা হত তেইশটি বাঘ, সিংহ ও চিতা! এর সাথে যোগ হয়েছিল কবুতরবাজি এবং ঘুড়ি ওড়ানো, যা পরবর্তীকালে কলকাতার বাবু সমাজের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সময়ের সাথে সাথে, আউধের থেকে লোকজন কলকাতায় পাড়ি জমাতে থাকে, তাদের প্রিয় নবাবের সান্নিধ্যে থাকার জন্য। মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে জনবসতিপূর্ণ হয়ে, ছোট লখনউতে রূপান্তরিত হয়। ১৮৭৪ সালের আমেরিকার বিখ্যাত একটি দৈনিকপত্রের এক প্রতিবেদন বলছে যে, কিছু আইনি ব্যাপার ছাড়া ব্রিটিশদের কোনও মাথা গলানো চলে না আউধের প্রাক্তন নবাবের গড়ে তোলা এই নকল রাজত্বে।
সে-রাজত্ব ছোট হলেও আঁটোসাঁটো। ছ’হাজার প্রজা নিয়ে দিব্যি চলে রাজ্যপাট। নবাবের জীবনযাত্রার মান ঊর্ধ্বমুখী হবার কারণে, মাসিক এক লক্ষ টাকার পেনশন শেষ হয়ে ধারকর্জ বেলাগাম! প্রতি মাসেই ধার হচ্ছে, আর সেটা পরের মাসে শোধ করা হচ্ছে!
ছোট লখনউতেই ওয়াজিদ আলী শাহের জীবনাবসান হয় ১লা সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ সালে। এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল তার, যে শেষ যাত্রায় প্রায় ১০,০০০ মুসলিম ও অমুসলিম লোকজন সঙ্গী হয়েছিলেন। সিবতৈনবাদ ইমামবাড়াতেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। নবাবের মৃত্যুর পরে, তার দেখনদার উত্তরাধিকারী হিসেবে ইংরেজরা নবাব বংশের একজনকে মনোনীত করেন। নবাবের সমস্ত সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়, এবং চিড়িয়াখানা থেকে সমস্ত পশু-পাখিদের আলিপুর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়। কয়েকটা বাড়ি ছাড়া, নবাবের বানানো প্রায় সবকয়টি মহল ভেঙে ফেলা হয়। তবে ধর্মীয় কারণে বেঁচে যায় সিবতৈনবাদ ইমামবাড়া। পরবর্তীকালে নবাবের বড়ো ছেলে বিরজিস কদ্র (Birjis Qadr) নেপাল থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন, এবং তার মৃত্যুর পরে এই ইমামবাড়াতেই ওনার সমাধি হয়। বর্তমানে কলকাতা কর্পোরেশন থেকে এটিকে একটি হেরিটেজ প্রপার্টি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
আজ মেটিয়াবুরুজের নবাবপাড়ায় হাঁটলে জেমস ফ্রেজার-এর আঁকা খিদিরপুরের রাস্তার দৃশ্যের সঙ্গে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এক শাহি ইমামবাড়া ছাড়া সেই যুগের ছবি ধরে রাখার মতো কিছু মিল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিরাট গেট দিয়ে ইমামবাড়ার ভিতরে ঢুকলে, বাইরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ঢুকেই একটা বড়ো উঠোন, যেটা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেই মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়া ইমামবাড়ার মূল হলঘরটি, যার ছাদ থেকে ঝুলছে বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়লণ্ঠন। উঠোনের বামদিকে রয়েছে অফিসঘর এবং উপরে ওঠার সিঁড়ি।
হলঘরে ঢুকেই বামদিকে একটা ঘিরে দেওয়া ঘরের মধ্যে রয়েছে ওয়াজিদ আলী শাহের সমাধি, যার ওপরে রাখা তাজিয়াটি রুপোর তৈরি। পাশেই আছে নবাবের সিংহাসন, ঢাল তলোয়ার। উপাসনাগৃহে বিভিন্ন ধর্মীয় নিদর্শনের সাথে রাখা আছে নবাবের কোর্ট অফ্ আর্মস। হলের আরেক প্রান্তে রয়েছে বিরজিস কদ্রের সমাধি, তার ওপরে রাখা আছে নবাবের হাতে লেখা কোরআন। এছাড়াও রয়েছে একটা যুদ্ধের ছবি, কিন্তু সেটা কোন সম্পর্কিত বুঝতে পারলাম না। পাথরের ওপর একটা পায়ের ছাপ রয়েছে, কিন্তু সেটা যে কার সেটাও পরিষ্কার হলো না। নবাবের বৃদ্ধ বয়সের ছবিও রয়েছে, এবং রয়েছে নবাবের প্রধান বেগম হজরত মহলের একটি ছবি। ইমামবাড়ার আরেকটি অংশে রয়েছে নবাবের বংশের উত্তরাধিকারীদের কয়েকটি সমাধি, কিন্তু সেখানে সেদিন পরিবারের লোকজন থাকায় আর প্রবেশ করা গেল না।
সিবতৈনবাদ ইমামবাড়া শিয়া সম্প্রদায়ের উপাসনাস্থল, কিন্তু এই এলাকাটা মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের। কোলকাতায় এসে অর্থ সংকটের মধ্যে ওয়াজিদ আলী ইচ্ছে করেই লখনউ-এর বড়ো ইমামবাড়ার নাম এবং স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে এখানে ইমামবাড়া তৈরি করেন। ঐতিহাসিক ও স্কলার রোজি লেওয়েলিন-জোনসের (Rosie Llewelyn-Jones) মতে, এই কারণে লখনউ-এর বড়ো ইমামবাড়ার থেকে ধর্মীয় গুরুত্বে এই সিবতৈনবাদ ইমামবাড়াকে একই আসনে রাখা যায়।
বিশেষ তথ্য সহায়তা: আমার বান্ধবী রুনা রহমান।
তথ্যসূত্র:
১. Llewellyn-Jones, Rosie. The Last King in India: Wajid Ali Shah. London: Hurst and Company, 2014.
২. Sharar, Abdul Halim. Lucknow: The Last Phase of an Oriental Culture. Translated by E.S. Harcourt and Fakhir Hussain. In The Lucknow Omnibus. New Delhi: Oxford University Press, 2001.
৩. মেটিয়াবুরুজের নবাব - শ্রীপান্থ
৪. wikipedia.org/wiki/%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%A6_%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A6%BF_%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B9
৫. anandabazar.com/rabibashoriyo/the-time-when-lat-nawab-of-awadh-wajid-ali-shah-lived-in-kolkata-1.761756
৬. anandabazar.com/west-bengal/kolkata/remembering-wajid-ali-shah-on-his-200th-birthday/cid/1448799
৭. amritmahotsav.nic.in/district-reopsitory-detail.htm?16459
৮. amritmahotsav.nic.in/district-reopsitory-detail.htm?16462
Comments
Post a Comment