কৃষ্ণরায় মন্দির, কাঁচড়াপাড়া (Krishna Rai Temple, Kanchrapara)

কাঁচড়াপাড়া নিয়ে বলতে গেলে, প্রথমেই বলতে হয় যে এই অঞ্চল এক সময়ে বাংলাদেশের সারস্বত অবদানের উৎসস্থল হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল। তখন এই অঞ্চলের নাম ছিল কাঞ্চনপল্লী, এবং সেটি নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য জেলাটি ভাগ করেন, এবং এটি উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এরকমও শোনা যায়, মুঘল আমলে বহু লোককে এখানে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। নির্বাসিত হওয়া প্রথম কয়েকজনের মধ্যে একজন আহমেদ বেগ এবং পরে মল্লিক বারখোরদার নামে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি এই এলাকা এবং চারপাশকে সুন্দর বাগান সহ একটি সমৃদ্ধ স্থানে গড়ে তোলার বিষয়ে আগ্রহী হন। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে, এখানে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া ব্রডগেজ রেললাইন আসে, এবং পরবর্তীকালে একটি লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ এবং রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর ফলে, ধীরে ধীরে কাঁচড়াপাড়া একটি পরিকল্পিত রেলওয়ে টাউনশিপ হিসেবে গড়ে ওঠে। 

এখানে বাগ মোড়ের কাছে রথতলায় রয়েছে একটি সুবৃহৎ রাধাকৃষ্ণ মন্দির। এটির সুন্দর রূপ এবং সুঠাম গঠন সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢোকার সময় প্রবেশপথের ওপরে লেখা আছে "শিবানান্দ সেনের শ্রীপাট এবং কৃষ্ণরায় মন্দির"। আজকে আমরা এই মন্দিরের বিষয়ে একটু জেনে নেব। 


বিভিন্ন বৈষ্ণবগ্রন্থে দেখা যায়, এই কাঞ্চনপল্লীকে সেন শিবানন্দের পাট বলে উল্লেখ করা আছে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু শিবানন্দের বাড়িতে এসেছিলেন এবং এখান থেকে প্রথমে শান্তিপুরের অদ্বৈত আশ্রমে এবং পরে নবদ্বীপে মায়ের সাথে দেখা করতে যান। নিজের গুরু শ্রীনাথ আচার্য্যর নামে, শিবানন্দ একটি কৃষ্ণরায় বিগ্রহের সেবা করতেন, যেটি ছিল আচার্য্যর দৌহিত্র শ্রীমহেশের বাড়িতে।



জনশ্রুতি আছে, মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্য তার খুড়তুতো ভাই যশোহরজিৎ কচুরায় যাচ্ছিলেন দিল্লীর সম্রাটের কাছে। যাত্রাপথে পরে কাঞ্চনপল্লী, এবং সেখানে তিনি কৃষ্ণরায় বিগ্রহটি দর্শন করে মানত করেন যে, কাজে সফল হলে তিনি দেবতার জন্য মন্দির বানিয়ে দেবেন। যথাসময়ে তিনি দিল্লী পৌঁছান এবং নিজের কাজে সফল হন। তাই ফেরার পথে বহু অর্থব্যয় করে তিনি একটি বিরাট মন্দির, ভোগমন্দির, দোলমঞ্চ ইত্যাদি তৈরি করে দেন। মন্দিরের সেবায় 'কৃষ্ণবাটি' নামের একটা তালুক তিনি দেবোত্তর করে দেন। বহুকাল সেই মন্দিরেই বিগ্রহ পূজিত হতে থাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গঙ্গার ভাঙনে যখন পুরনো কাঞ্চনপল্লী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এই যশোহরজিতের মন্দিরটিও গঙ্গাবক্ষে তলিয়ে যায়।


পরবর্তীকালে, ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমানের মন্দিরটি নির্মাণ করেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা নিবাসী জমিদার নয়নচাঁদ মল্লিকের দুই ছেলে, শ্রী গৌরচরণ ও নিমাইচরণ মল্লিক। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলকে এনাদের নাম লেখা আছে। মন্দিরটি নির্মাণে সেই সময় খরচ হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ টাকা। প্রতিষ্ঠার সময় কাঙালী ভোজনের পর প্রত্যেককে দুই টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, মন্দিরের খরচের জন্য অনেকটা জমি দেবোত্তর করে দেওয়া হয়।



মন্দিরটি চওড়া ৪০ ফিট, লম্বা ৬০ ফিট এবং উচ্চতা ৭০ ফিট। ভিত্তিবেদি ৬ ফিটের বেশি উঁচু। রাস্তার ওপরে মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে দেখা যায় একটি চওড়া খোলা জায়গা, যেখানে শ্রী চৈতন্যদেবের একটি মূর্তি রয়েছে। এরপরে রয়েছে একটি ছোট প্রবেশদ্বার, যেটা দিয়ে মূল মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। বিরাট মন্দির প্রাঙ্গণটি বিভিন্ন ফুলগাছ দিয়ে সজ্জিত। 


সুবৃহৎ মন্দিরটি বাংলার আটচালা রীতিতে নির্মিত। দরজা জানালা ছাড়া, আর কোথাও কাঠের কোনো কাজ নেই। গর্ভগৃহের দরজার খোদিত আছে দশম-অবতার এবং বিভিন্ন লতাপাতার কাজ। কোনো কড়ি বরগার ব্যবহার নেই এখানে। মন্দিরের গায়ে অনেকগুলো পোড়ামাটির পদ্মফুলের মোটিফ রয়েছে। প্রবেশপথে রয়েছে তিনটি খিলান। এছাড়াও মন্দিরের উপরে রয়েছে পাঁচটি কারুকার্যখচিত স্তম্ভ, যায় একটির মাথায় চক্র এবং চারটির মাথায় ছোট পতাকার নিশান আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের আসনে বিরাজমান আছেন কষ্টিপাথরের শ্রীকৃষ্ণ এবং অষ্টধাতুর রাধার মূর্তি। 


মন্দিরের থেকে একটু দূরেই আছে একটি দোলমঞ্চ, এবং ভোগ রান্নার ঘর। সিংহদুয়ারের ডানদিকে একটা টিনের ঘর আছে, যেখানে উৎসবের সময় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রোজ পাঁচ সের চাল এবং অন্যান্য বা সহকারে দেবতার ভোগ রান্না করা হয়। রথের সময়ে এখানে বিরাট করে অনুষ্ঠান হয়, এবং রথযাত্রার সময় দেবতাকে রথে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে রথটি কাঠের থাকলেও, একবার সেটা আগুনে পুড়ে যাওয়ায়, সেটিকে তারপর লোহার বানিয়ে দেওয়া হয়। 


বর্তমানে মন্দিরটির ট্রাস্টের অধীনে। ট্রাস্টের অন্যতম সদস্যরা মল্লিক বাড়ির। তবে একটা বিষয় খারাপ লাগলো, মন্দিরের দেওয়ালে প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের নাম লিখে সেটাকে অক্ষয় করার চেষ্টা করছে! বিষয়টি আমি ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্যকে জানানোর পর জানতে পারলাম, তারা বহুবার বারণ করা এবং নজর রাখার পরেও, এই জিনিষ ঘটে চলেছে। সত্যি বলতে, যতদিন না মানুষের নিজেদের বিবেক থেকে এই জিনিসটা বুঝতে না পারবে, এর কোনোদিন শেষ হবে না।

তথ্যসূত্রঃ
১. কাঁচড়াপাড়ার কথা - শ্রী সঞ্জীবকুমার বসু
২. নদীয়া কাহিনী - কুমুদনাথ মল্লিক

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)