বটানিক গার্ডেন এবং ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনকের গল্প (Botanic Garden and the Father of Indian Botany, William Roxburgh)

হাওড়া শিবপুর অঞ্চলে হুগলি নদীর তীরে বটানিক গার্ডেনের নাম তো ভারত বিখ্যাত। সাধারণভাবে বলা হয়, এ উদ্যান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের অধিকারী ফোর্ট উইলিয়ামের সামরিক বিভাগের তৎকালিন সচিব, শৌখিন উদ্ভিদবিদ কর্নেল রবার্ট কিড (১৭৪৬-১৭৯৩)। ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনামলে ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই উদ্যানের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল The Hon’ble Company’s Botanic Garden, Calcutta। ১৯৫০ সালে গার্ডেনের নতুন নামকরণ হয় ‘ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন, হাওড়া’। বর্তমানে এর নাম আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে। 
রবার্ট কিড ছিলেন এই উদ্যানের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট। কাইডের মূল উদ্দেশ্য ছিল, অর্থনৈতিক লক্ষ্যে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করা... যেখানে দারুচিনি, ঢাকা কটন, নীল, তামাক, কফি, চন্দন,  মরিচ, চা ইত্যাদি চাষ করা হবে। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী জায়ফল, লবঙ্গ, দারুচিনি, মরিচ ইত্যাদি চাষের প্রয়াস সফল হয় না কারণ, এসব বিষুবীয় প্রজাতির গাছপালার জন্য এ স্থানের জলবায়ু মোটেই অনুকূল ছিল না। বিষুবীয় অঞ্চলের ফল এবং ইউরোপীয় নাতিশীতোষ্ণ ফল চাষেরও চেষ্টা চলে, কিন্তু তাও ব্যর্থ হয়। তবে উদ্যানে তিনি বিপুল সংখ্যক গাছপালা রোপণ করেন এবং এখানের থেকে ভারতের অন্যান্য উদ্যানেও সেগুলোর চারা পাঠিয়ে সফল হন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই উদ্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তার শেষ ইচ্ছা ছিল যে এখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হোক, কিন্তু মৃত্যুর পর তাকে সাউথ পার্ক কবরখানাতে সমাধিস্থ করা হয়। ওনার স্মৃতিতে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয় উদ্যানের মধ্যে।

রবার্ট কিডের পর এই বাগানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন উইলিয়াম রক্সবার্গ (William Roxburgh)। বটানিক গার্ডেনের উন্নতি হয় এনার আমলেই। তবে সেগুলো সম্পর্কে জানার আগে, তার সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক। পূর্ব স্কটল্যান্ডের আয়ারশায়ারে ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত ব্রিটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক John Hope এর সান্নিধ্যে এসে উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। একজন সার্জন-এর সহযোগী হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজে তার চাকরি জীবন শুরু হয়। 

১৭৮০ সালে রক্সবার্গ সার্জন হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময়ে তার চাকরির প্রথম ভাগ অতিবাহিত হয় মাদ্রাজ থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উত্তরে সামালকোট-এর (Samalkot) গ্যারিসন স্টেশন (garrison station) বা সেনা কেন্দ্রে। সামালকোটে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে কফি,  মরিচ, দারচিনি, নীল এবং ব্রেডফ্রুট (breadfruit) চাষ করেন এবং সে সঙ্গে লাক্ষাজাতীয় পতঙ্গের (cochineal insect) পোষক উদ্ভিদ Opuntia-এর ওপর পরীক্ষা পরিচালনা করেন। ১৭৯০ সালে তিনি এবারডীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং এডিনবরা রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস (Royal College of Physicians, Edinburgh)-এর ফেলো নির্বাচিত হন।

রবার্ট কিডের মৃত্যুর পর রক্সবার্গ ১৭৯৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বটানিক উদ্যানের সুপাররিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।  একই বছরে গার্ডেনার হিসেবে এখানে নিযুক্ত হন ক্রিস্টোফার স্মিথ। তারা দুজনে মিলে এই উদ্যানের উন্নতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন, এবং তাদের আমলেই বটানিক গার্ডেনের প্রভূত উন্নতিসাধন হয়।

রক্সবার্গ ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্য থেকে উদ্ভিদ সংগ্রহ শুরু করেন এবং একটি হার্বেরিয়াম গড়ে তোলেন। দারুচিনি চাষের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। বিশেষত জায়ফল ও লবঙ্গ গাছের জন্য স্মিথ মালাক্কা গিয়েছিলেন। রক্সবার্গ শন ও অতসীসহ (hemp, flax) নানা ধরনের আঁশযুক্ত উদ্ভিদ চাষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। বটানিক গার্ডেনে মেহগনি ও সেগুন রোপণ করা হয় এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে সেগুন বন গড়ে তোলা হয়। তবে বাংলায় সেগুন চাষ সফল হয় নি। আঁশযুক্ত উদ্ভিদ নিয়ে রক্সবার্গের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়, কারণ তিনি শন ও অতসী গাছের কয়েকটি ভারতীয় বিকল্প উৎপাদনে সক্ষম হন।

সামালকোটে ও কলকাতায় রক্সবার্গ এক দল দেশি চিত্রশিল্পীকে ইউরোপীয় শৈলীতে বিভিন্ন উদ্ভিদের চিত্র আঁকার প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে তিনি ভারতীয় উদ্ভিদের কয়েক হাজার ছবি তৈরি করান। রক্সবার্গের এসব সংগ্রহ ও চিত্রের উপর ভিত্তি করেই, ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়।

রক্সবার্গ ভারত ত্যাগের পরে উইলিয়াম কেরী (William Carey) বটানিক গার্ডেনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৮১৪ সালে ১৫১০টি উদ্ভিদ প্রজাতির ওপর Hortus Bengalensis নামে এক ক্যাটালগ (catalogue) প্রকাশ করেন। সবগুলি উদ্ভিদই ঐ সময় বাগানে ছিল। এছাড়া রক্সবার্গ Flora Indica নামে এক পান্ডুলিপি উইলিয়ম কেরীর হাতে দিয়ে যান। ১৮২০ সালে কেরী এটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার আগে অবশ্য উদ্যানের এক কর্মকর্তা ন্যাথানিয়েল ওয়ালিক (Nathaniel Wallich) আরও কিছু উদ্ভিদের বর্ণনা এতে সংযোজন করেন। বইটির প্রথম খন্ড ১৮২০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খন্ডে ওয়ালিক নতুন আরও অনেক তথ্য ও বর্ণনা যোগ করেন এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৮২৪ সালে।

১৮৭২ সালে বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার জোসেফ হুকার প্রণীত Flora of British India গ্রন্থের প্রকাশনা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত রক্সবার্গের Flora Indica-ই ছিল একমাত্র গ্রন্থ যা থেকে ভারতীয় উদ্ভিদ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা যেত।

রক্সবার্গ যখন উদ্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সেখানে প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছপালা ছিল। ১৮১৩ সালে তার অবসর গ্রহণকালীন সময়ে ঐ বাগানে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০০। এছাড়া ২৫৩৩টি বিজ্ঞানসম্মত চিত্র তিনি রেখে যান। এসব চিত্র এবং তার তৈরি অসংখ্য উদ্ভিদের শুষ্ক নমুনা (dry specimens) পরবর্তীকালে এ উপমহাদেশের অন্যতম এক বিশিষ্ট হার্বেরিয়াম (herbarium) প্রতিষ্ঠার সূচনা করে।

রক্সবার্গ নিঃসন্দেহে এ উপমহাদেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানের পথিকৃৎ, এবং তিনিই প্রথম ভারতীয় উদ্ভিদের একটি ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল বিবরণী প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে তার রচিত Flora Indica-এর মাধ্যমেই সূচিত হয় এই উপমহাদেশে উদ্ভিদ-সংক্রান্ত গবেষণা কাজ। ১৮১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এডিনবার্গে তিনি দেহত্যাগ করেন। 


বটানিক গার্ডেনে থাকাকালীন যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, তার কাছেই ওনার উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত তার নামাঙ্কিত সেই বাড়িটি খুবই অযত্নে পরে ছিল, কিন্তু ২০২২ সালে সেটা মেরামতের কাজ শুরু হয়। আমি যখন দেখেছি তখনও মেরামত চলছে। আশা করি, ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার এই জনকের নাম, মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।


তথ্যসূত্র:
The Botanic Garden - Dr. Anis Mukhopadhyay.
2.    “The Bengal Obituary”, Publisher : W. Thacker & Co.
3.    Wikipadia, Robert Kyd & William Roxburgh.
4.    “Annals of Royal Botanic garden, Calcutta,” “preface” by George King.
5.    “The European discovery of the Indian Flora”. By Desmond Ray,Oxford University Press.
6.    “Botanic Garden Heritage House by Sanjoy Mondal,The telegraph.29th Sept,2008.

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)