উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী : এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরী (Uttarpara Jaykrishna Library: The First Public Library of Asia)

হুগলি জেলার একটি বিশিষ্ট জনপদ হলো উত্তরপাড়া। হাওড়ার শেষ উত্তরে বালিগ্রাম এখন শহর। তার লাগোয়া উত্তরে বালিখাল পেরিয়ে হুগলি জেলার প্রথম শহরটি উত্তরপাড়া । শহরের পত্তনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের জনক লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরীর বড় ছেলের নাতি রত্নশ্বের রায়চৌধুরী, শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায়ের কাছ থেকে ১৭০৯ খ্রিষ্টাব্দে চকবালির উত্তরাংশ কিনে পত্তন করেন উত্তরপাড়া।

এই উত্তরপাড়ায় রয়েছে একটি বিরাট বড়ো পাবলিক লাইব্রেরি, যার পত্তন করেছিলেন এখানকারই বিশিষ্ট জমিদার এবং সমাজ সংস্কারক জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। এটি ভারতের প্রথম এবং সম্ভবতঃ এশিয়ার প্রথম বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্য গ্রন্থাগার।

লাইব্রেরীর বিষয়ে আরো বলার আগে, জেনে নেওয়া যাক জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কে। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে আগস্ট উত্তরপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারের তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে কিছুদিন হিন্দুস্কুলে পড়াশোনা করলেও, পিতার কর্মসূত্রে মাত্র ৮ বছর বয়সেই তিনি মিরাটে চলে যান এবং রেজিমেন্ট স্কুলে জয়েন করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে হুগলির ভূমি রাজস্ব বিভাগের রেকর্ড রক্ষকের চাকরীতে নিযুক্ত হন এবং বিবাহসূত্রে সাবর্ণরায় চৌধুরী পরিবারের জামাতা হন। সেসময় বন্যার কারণে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জমিদারি এস্টেট একের পর এক বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। জয়কৃষ্ণ সেগুলি একে একে কিনে নেন, এবং একসময় তার সম্পত্তির পরিমাণ দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমতুল হয়ে দাঁড়ায়। শেষে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে চাকরি ছেড়ে উত্তরপাড়া জমিদারির পত্তন করেন। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত জমিদার সংঘের (Landholder's Association) সভ্যও হন।


তবে জয়কৃষ্ণ শুধুমাত্র জমিদার হয়েই থেকে জন্য নি। হুগলির উত্তরপাড়াকে যেমন তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনই বহু বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজও করে গেছেন। দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল স্থাপন ছিল তার অন্যতম কীর্তি। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের কলেরা মহামারীর পর তার উদ্যম ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপাড়া পৌরসভা গঠিত হয়। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরী, উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী (যদিও এই এশিয়ার প্রথম বিষয়টি বিতর্কিত, কারণ কোন্নগর পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে)। গঙ্গার তীরে বাঁধানো ঘাট, বিশাল খেলার মাঠ সমন্বিত বহুতল এই গ্রন্থাগারটির এই পরিকাঠামো আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগারের সমতুল। লম্বা লম্বা থামওয়ালা প্রাসাদোপম বাড়ি, কাঠের বিশাল ঝুলন্ত বারান্দা, ছক কাটা মেঝে, উজ্জ্বল সবুজ খড়খড়িওয়ালা জানলা, কাঠের রাজকীয় আসবাবপত্র মিলিয়ে এক এলাহী ব্যাপার! এক সময় সামনের বাগানে ফুটে থাকত মনোমুগ্ধকর সব ফুল!

তবে এই লাইব্রেরিতে শুধু বইয়ের সমাহার ছিল না, বরং বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির মিলনস্থলও ছিল এই স্থানটি। তাঁরা আসতেন, থাকতেন, পড়তেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলত। ১৮৬৬ সালে বিদ্যাসাগর এই লাইব্রেরীতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মেরি কারপেন্টারকে সঙ্গে নিয়ে। কিছুকাল পরে যখন তাঁর বই “Six months in India” প্রকাশিত হয়, সেখানে এই লাইব্রেরীর একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় মিস কারপেন্টারের লেখায়। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, বাড়িটির নিচের তলায় ছিল গ্রন্থাগার, যেখানে বাংলা ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষার বই ও পুঁথি রাখা থাকতো। উপরের তলার ঘরগুলি বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের (ভিজিটর) থাকার জন্যে এবং সভাসমিতি করার জন্যে রাখা হয়েছিল। আর কে নেই সে তালিকায়? বিদ্যাসাগরের কথা তো বলেইছি। তাছাড়াও মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬৯ এবং ১৮৭৩ সালে দুবার পরিবারসহ মাসাধিক কাল কাটিয়ে গেছেন। এসেছেন স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার, জন এইচ এস কানিংহাম, রেভারেন্ড জেমস লং, স্যার আর্থার ওয়েলেসলী, স্যার অ্যাসলী ইডেন, স্যার এডুইন আর্নল্ড, স্যার রিভারস থম্পসন, মারকুইস অব ডাফরিন এবং আভা ডাফরিন এর মত বই পিপাসু বিদেশী জ্ঞানী গুণিজন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জী, কেশবচন্দ্র সেন এবং বিপিন চন্দ্র পালের মত স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও পদধূলি পড়েছে এই গ্রন্থাগারে। ১৯০৯ সালে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দও এসেছেন। বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ১৯০৯ সালে তাঁর বিখ্যাত “উত্তরপাড়ার ভাষণ” এই লাইব্রেরির মাঠে দাঁড়িয়েই দিয়েছিলেন। এমন কি ডোভার লেনের পর বাংলার সব থেকে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাৎসরিক আসরও বসে এই লাইব্রেরির মাঠে। কিছুদিন আগে সরকারি তরফে একে জাতীয় হেরিটেজের তালিকাতেও আনা হয়েছে। 


প্রায় ৩ হাজার বই নিয়ে উত্তরপাড়া লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হলেও, এখন সব মিলিয়ে আছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বই, ২৫০০টির কাছাকাছি পুরোনো পত্রিকা এবং ২৫০টির বেশি পুঁথি। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম, বর্তমানে লাইব্রেরীর অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। কিছুদিন আগেও লাইব্রেরিটির দেড়শো বছর উদযাপনও হয়েছে ধুমধাম করে। কিন্তু এখন লাইব্রেরিয়ান ও কর্মীর অভাবে ধুঁকছে লাইব্রেরী। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না হবার কারণে, এখানে কুকুরদের বেশ উপদ্রব। গেটে রক্ষী থাকলেও, পরিচিত স্থানীয় লোকজন এখানে গঙ্গার ধারে সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেন। এর মূল কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, বর্তমানে লাইব্রেরির প্রতি মানুষের অনীহা। ভবিষ্যতে যদি একটি হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে এবং একটি সমৃদ্ধশালী লাইব্রেরী হিসেবে এর কদর না করা হয়, তাহলে অচিরেই এটি তলিয়ে যাবে কালের গর্ভে। 

তথ্য সূত্র:
১. wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9C%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3_%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC#:~:text=%E0%A6%9C%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3%20%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%20%E0%A7%A7%E0%A7%AE%E0%A7%A6%E0%A7%AE%20%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0,%2C%20%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3%2C%20%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3%20%E0%A6%93%20%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A3%E0%A5%A4

২. wikipedia.org/wiki/%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A6%BC%E0%A6%BE_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%95_%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A7%80

৩. anandabazar.com/west-bengal/howrah-hooghly/uttapara-tmc-mp-santasree-chaterjje-wrote-letter-to-siddiqullah-chowdhury-for-renovation-and-recruitment-in-jaykrishna-library/cid/1447125

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)