মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়ি, বেলঘরিয়া (Motilal Seal's Thakurbari, Belgharia)
ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ওপরে, একটা জায়গার নাম রথতলা (জায়গাটা কামারহাটি পৌরসভা ভবনের কাছে)। এখানেই রাস্তার ওপরে একটা বাগান দিয়ে ঘেরা ঠাকুরবাড়ি রয়েছে, যায় সাথে জড়িয়ে আছে পুরনো কলকাতার বিখ্যাত ব্যাবসায়ী বাবু মতিলাল শীলের নাম। জায়গাটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আগে, একটু জেনে নেওয়া যাক মতিলাল শীল সম্পর্কে।
১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম হয় মতিলাল শীলের। মুখের সোনার বা রুপোর চামচ নিয়ে জন্ম হয় নি তার। বাবার একটা ছোট কাপড়ের ব্যাবসা ছিল, কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহীন হন। চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে বড়ো হলেও, মতিলাল ছিলেন বুদ্ধিমান এবং করিৎকর্মা। ১৮১৫ নাগাদ তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে কাজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার বরাত পান। এরপর নিজ ক্ষমতা আর বুদ্ধিবলে আস্তে আস্তে উন্নতি করতে থাকেন। নীল, চিনি, কাপড়, চাল এই সব চেনার এবং পরখ করার ক্ষমতার জন্য তৎকালীন বেশ কিছু এজেন্সি তাঁকে ‘বেনিয়ান’ হিসাবে নিয়োগ করেন। অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে, তিনি অনেক সামাজিক সংস্কারের কাজ করেন। বিধবা বিবাহের সমর্থন, ফ্রি কলেজ নির্মাণ এবং মেডিক্যাল কলেজ তৈরীর জন্য ১২০০০ টাকার অনুদান দেওয়া ইত্যাদি অনেক কাজ তিনি করেছেন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে।
নিজের জীবদ্দশায় ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে বেলঘরিয়ার কাছে তিনি অনেকটা জায়গা নিয়ে এই ঠাকুরবাড়ির পত্তন করেন (বর্তমান ঠিকানা ৩ নং বি. টি. রোড)। এর চারদিকে রয়েছে একটা বড়ো বাগান, যেখানে আছে প্রচুর ফুল ও ফলের গাছ... যেগুলো দেবতার সেবায় কাজে লাগে। এছাড়াও আছে একটা বড়ো পুকুর, যেখানে মাছ কিলবিল করে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এখানে মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
এই ঠাকুরবাড়ি তৈরীর পিছনে মতিলাল শীলের উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র মানুষের সেবা। কারণ তার জীবদ্দশায় এখানে ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিদিন ৫০০-১০০০ মানুষকে খাওয়ানো হতো। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের সময়, এখানে তার ছেলে বাবু হীরালাল শীলের (Baboo Heera Loll Seal) উদ্যোগে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার মানুষের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করা হতো। সেই বিপুল আয়োজন এখন না থাকলেও, গরীব-দুঃখীদের খাওয়ানোর বিষয়টা এখনো চালু রয়েছে।
মুল ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে, কিছুটা এগোলে সামনে পরবে বাঁধানো চাঁদনী দেওয়া পুকুরঘাট। তার আগে ডান দিকে রয়েছে মতিলাল শীলের একটি আবক্ষ ছাতাওয়ালা মূর্তি, এবং বামদিকে রয়েছে ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশের দরজা। অনেকটা দালানরীতিতে তৈরী এই ঠাকুরবাড়ির উঠোনে পা দিলেই একটা শান্ত পরিবেশ অনুভব করা যায়। মূল মন্দিরের যে ছোট চূড়াটি, সেটা বানানো রোমান পেডিমেন্টের আদলে, যাতে একটি ইহুদি তারার চিহ্ন এবং ওঁ-কার রয়েছে।
এখানে নিত্য-পূজিত হন জগন্নাথ এবং গৌর-নিতাই। তিনটি বিগ্রহ কাঠের তৈরী। এছাড়াও সিংহাসনে রয়েছে একটি নারায়নশিলা। ১৮ই জুন ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ এই ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন, এবং বিগ্রহদর্শনের সাথে সাথে, পুকুরের পাশে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছেন। পেনেটির শ্রীযুক্ত মণি সেনের বাড়িতে, রাঘব পণ্ডিতের চিঁড়ার মহোৎসবের থেকে ফেরার পথে তিনি এখানে আসেন।
শ্রীম রচিত শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত বইতে সেই দর্শনের বর্ণনা পাওয়া যায়:
"পথে মতিশীলের ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুর মাস্টারকে অনেকদিন হইল বলিতেছেন - একসঙ্গে আসিয়া এই ঠাকুরবাড়ির ঝিল দর্শন করিবেন - নিরাকার ধ্যান কিরূপ আরোপ করিতে হয়, শিখাইবার জন্য।
ঠাকুরের খুব সর্দি হইয়াছে। তথাপি ভক্তসঙ্গে ঠাকুরবাড়ি দেখিবার জন্য গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন।
ঠাকুরবাড়িতে শ্রীগৌরাঙ্গের সেবা আছে। সন্ধ্যার এখনও একটু দেরি আছে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে শ্রীগৌরাঙ্গ-বিগ্রহের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
এইবার ঠাকুরবাড়ির পূর্বাংশে যে ঝিল আছে তাহার ঘাটে আসিয়া ঝিল ও মংস্য দর্শন করিতেছেন। কেহ মাছগুলির হিংসা করে না, মুড়ি ইত্যাদি খাবার জিনিস, কিছু দিলেই বড় বড় মাছ দলে দলে সম্মুখে আসিয়া ভক্ষণ করে - তারপর নির্ভয়ে আনন্দে লীলা করিতে করিতে জলমধ্যে বিচরণ করে।
ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “এই দেখ, কেমন মাছগুলি। এইরূপ চিদানন্দ-সাগরে এই মাছের ন্যায় আনন্দে বিচরণ করা।”
প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১১টা এবং বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই ঠাকুরবাড়ি দর্শনের জন্য খোলা থাকে।
তথ্যসূত্র:
১. motilalseal.com/msp/thakurbari/
২. মতিলাল শিল - জলধর মল্লিক
৩. শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত - শ্রীম কথিত
Comments
Post a Comment