রিষড়ার শ্রীমানি বাড়ির দুর্গাপুজো (Durga Puja of Srimani Family of Rishra, Hooghly)
হুগলী অঞ্চলে অনেকগুলো বনেদি বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়, আর তার মধ্যে অনেকগুলোই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে মিডিয়ার কল্যাণে। কিন্তু কিছু এমন পুরনো বাড়ি রয়েছে, যার পুজো নিষ্ঠা মেনে হলেও, এখনো সেরকম মিডিয়ার নজর পরে নি। এরকমই একটি বাড়ি হলো হুগলীর গঙ্গাপাড়ের জনপদ রিষড়ার শ্রীমানি পরিবারের দুর্গাপুজো।
ভাগ্যের সন্ধানে শ্রীমানি পরিবারের বাস এখানে শুরু হয় মুসলিম আমলের শেষের দিক থেকে। এনারা মাকরদহের শ্রীমানিদেরই সরাসরি আত্মীয়। পরিবারের উল্লেখযোগ্য পুরুষ হিসেবে নাম পাওয়া যায় শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র শ্রীমানির, যিনি এই অঞ্চলের কিছু উন্নতিসাধন করেছিলেন, যার মধ্যে শ্রীমানি ঘাট এখনো বিদ্যমান। পূর্বে এই ঘাট দিয়েই নৌকা চলাচল করতো, পরে একটু পাশে সমশানের গা ঘেঁসে নতুন ফেরিঘাট বানানো হয়।
সেই সময়, কৃষ্ণচন্দ্র শ্রীমানির আমলে বা তার পিতার তত্ত্বাবধানে পরিবারে শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো। সেই সূত্রে পুজোর বয়স প্রায় ৩০০ বছর। তবে যথাযথ প্রথা অনুসারে পুজো শুরু হয় কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রীর আমলে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় পর্দাপ্রথার বাড়াবাড়ি থাকলেও, এই পুজোকে তা স্পর্শ করেনি।
মহিষাসুরমর্দিনী মা এখানে কন্যারূপে পূজিত হন। বর্তমান পূজামণ্ডপটির বয়স প্রায় ১০০ বছর। এর আগে আরো দুটো দুর্গামণ্ডপ ব্যবহার হয়েছে (সেগুলো এখন পরিত্যক্ত)। কাঠামোটি বহু প্রাচীন, অনেক বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে। জন্মাষ্টমীতে এই কাঠামো পুজোর পরে শুরু হয় প্রতিমা তৈরি, আর পঞ্চমীর বিকেলে হয় দেবীর চক্ষুদান। এরপরে দেবীকে সাজানো শুরু হয়। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড়ির সদস্যরা এসে হাজির হন এই উৎসবের অঙ্গ হতে। আগে বাড়িতেই বিভিন্ন মিষ্টি ও নাড়ু ইত্যাদি তৈরি হতো, বর্তমানে লোকের অভাবে বাইরে থেকেই মিষ্টি আনা হয়।
বর্তমানে (ইং ২০২২) পরিবারের সবথেকে বয়স্ক সদস্যা হলেন গৌরী শ্রীমানি। উনি এই বয়সেও পুজোর সমস্ত অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। সাথে সহযোগিতা করছে ছোট বড়ো মিলিয়ে সমস্ত শ্রীমানি পরিবার। এই পরিবারের এক সদস্যা শ্রীমতী গার্গী দাস শ্রীমানির (নিচের ছবিতে) আমন্ত্রণে, অষ্টমীর শুভদিনে আমি ছিলাম এই বাড়ির অতিথি।
পুরনো রীতি অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস, বেলগাছের নীচে বোধনতলায় মহাদেব চার দিন অপেক্ষা করে থাকেন (নিচের ছবিতে)। তাই পুজোর আগে বোধন ঘরে শঙ্খ, ঘণ্টা, বাদ্য সহযোগে শিবের পুজো করা হয়।
সপ্তমীর সকালে বড় পিতলের ঘট বসানো হয়। দেবীকে প্রতিদিন আড়াই কিলোগ্রাম চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়, সাথে থাকে জলখাবার এবং ফলাহার। সকালের দাঁতন বা মুখ আঁচানোর পরে পান, মা দুর্গার জন্য সব কিছুরই পরিপাটি আয়োজন থাকে শ্রীমানি বাড়িতে। অষ্টমীর দিন হোম, ধুনো পোড়ানো, কুমারী পুজোরও রেওয়াজ রয়েছে। আমি আজ এই প্রথাগুলো দেখলাম।
দশমীর দিন সকালে নির্দিষ্ট পাত্রে রাখা জলে মায়ের প্রতিবিম্ব দেখে আশীর্বাদ নেন পরিবারের সদস্যরা। এরপরে পরিবারে সকল সদস্য মৎসমুখ করে, বিকেলের দিকে দেবীকে বরণ হয়। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী, কাঠামোর দু’পাশে বাঁশ বেঁধে পালকির কায়দায় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মাকে নিয়ে যান গঙ্গায়। সকলেরই পরনে থাকে পাটভাঙা সাদা ধুতি। কাছের শ্রীমানি ঘাট থেকে, সপরিবারে মাকে নৌকোয় তোলা হয়। দু’টি নৌকোর মাঝে কাঠের পাটাতনে থাকেন দেবী। মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে, দুর্গাদালানের দিকে মুখ করে পাটাতনগুলো সরিয়ে বিসর্জিত হন দেবী। দেবীমূর্তি জলে নিমজ্জিত হবার পরে, কাঠামোটি আবার নিয়ে আসা হয় ঠাকুরদালানে.... শুরু হয় পরের বছরের জন্য প্রতীক্ষা।
তথ্য সহায়তা: কৌশিক শ্রীমানি, গার্গী দাস শ্রীমানি এবং সমগ্র শ্রীমানি পরিবার।
যাদের সাহায্য ছাড়া কাজটাই হতো না, তারা হলেন সংগীতা সিং এবং প্রকাশ পাল।
Comments
Post a Comment