একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)
রাস্তার ধারে আমরা কতো রকমের জিনিষ দেখি, কিন্তু সেটার প্রতি আমাদের চোখ যায় না। টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা বাসস্টপ আছে, যার নাম ঘড়িঘর (Ghari Ghar, Tollygaunge)। একটা গলির রাস্তা, আর তার ঢোকার মুখে একটা মাঝারি সাইজের পুরোনো গেট। সাদা রঙের গেটের ওপরে পড়েছে বহু যুগের ধুলো-ময়লার আবরণ, তাই এখন আর তাকে শ্বেত-শুভ্র মনে হয় না। অঞ্চলটা সাধারণ মানুষের কাছে বিখ্যাত একটা মোটর ড্রাইভিং স্কুলের জন্য।
কিন্তু কেনই বা এই গেট, আর কেনই বা এই অঞ্চলের নাম ঘড়িঘর? এর উত্তর লুকিয়ে আছে গেটের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া সেই গলিরাস্তার মধ্যে, যার নাম প্রিন্স রহিমুদ্দীন লেন (Prince Rahimuddin Lane)।
ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে, ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, সৈয়দ ওয়াল শরীফ সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু (Tipu Sultan) মহীশূরের নবাব হন (১০ নভেম্বর ১৭৫০ থেকে ৪ মে ১৭৯৯)। প্রবল ইংরেজবিদ্বেষী এই সুলতান ছিলেন, একজন বড় মাপের পণ্ডিত ও কবি। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ইঙ্গ মহীশূর বা শ্রীরঙ্গপত্তনমের যুদ্ধে পরাজিত হন মহীশূরের শাসক টিপু সুলতান, তাঁকে হত্যা করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ বাহিনীর মহীশূরের দখলের পর এবং টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছয় বছর পর, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর সমস্ত পরিবারকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। তাঁর একাধিক স্ত্রী, ১২ জন পুত্র-সহ পরিবারের মোট ৩০০ জন সদস্যকে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে রাষ্ট্র থেকে ছত্রভঙ্গ করা, এবং গোটা পরিবারকে যাতে নজরদারি করা যায়। কোলকাতায় তাদের থাকার জন্য জায়গা দেওয়া হয় রসা পাগলার গ্রামে, পরবর্তীকালে টলি সাহেবের নামে যার নাম হয় টলিগঞ্জ বা টালিগঞ্জ (Tollygaunge)। ধীরে ধীরে তাঁরা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী।
প্রিন্স রহিমুদ্দীন হলেন এই টিপু সুলতানের এক নাতি। এই গলিপথের ভিতরে একটু এগোলেই বাম দিকে চোখে পড়বে একটা ইমামবাড়া, যার স্থাপত্য অনেকটাই টিপু সুলতান মসজিদের মতো, অর্থাৎ দক্ষিণী স্টাইলের! শ্বেতপাথরের ফলকে উর্দু ও ইংরেজি হরফে লেখা আছে, ১৮৬৫ খৃস্টাব্দে প্রিন্স রহিমুদ্দীন শাহ এই ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠা করেন। ভিতরে ঢুকতে না পারলেও, একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের থেকে জানলাম একতলা এই ইমামবাড়ার ভিতরে দুটি বড়ো ঘর আছে, যার মেঝে মার্বেলপাথর-খচিত। ২০০৯ খৃস্টাব্দে এই ইমামবাড়ার সংস্কার হয়েছিল, এবং তারপর থেকে নিয়মিত রং করা হচ্ছে।
এবার আসা যাক গেটের কথায়। ইমামবাড়া তৈরির সময়েই প্রিন্স রহিমুদ্দীন এই তোরণটি তৈরি করেন, যার দুদিকে দুটি ধূলামলিন ফলকেও লেখা আছে এর জন্মবৃত্তান্ত। তবে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইমামবাড়ার ফলকে ব্যবহার হয়েছে উর্দু ও ইংরেজিভাষা, কিন্তু গেটের ফলকে রয়েছে উর্দু ও বাংলা লেখা। পুরোনো গেটটি সংস্কারের তেমন কোনো তারিখ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে কোলকাতা করপোরেশন থেকে এই রাস্তাটির নাম প্রিন্স রহিমুদ্দীনের নামে রাখা হয়।
এই রহিমুদ্দীনের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে আমি ১৯০০ সালের একটা হাইকোর্টের কেসের রেফারেন্স পাই, এই ইমামবাড়ার সাথে যার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, আমার মনে হলো বিষয়টি আপনাদের সাথে ভাগ করে নি! দুই বিঘা জমির দখলদারি নিয়ে একটা মামলা করেছিলেন প্রিন্স রহিমুদ্দীন, এবং পরবর্তীকালে সেই মামলা চালিয়েছিলেন তার এক পুত্র সুলেমান বক্ত (Suleman Bukt)। সেই মামলায় বাদিপক্ষের (Appellants) উকিল ছিলেন ডাক্তার রাসবেহারি ঘোষ (Dr. Rash Behary Ghose)। মামলার কি নিষ্পত্তি হয়েছিল, সেটার দিকে আমি যাচ্ছি না। শুধু একটা বিষয় আমার মনে হলো, যে কি আশ্চর্য..! আজকে এই দুজনের কেউই বেঁচে নেই, কিন্তু প্রিন্সের নামে রয়েছে একটি লেন, আর উকিলবাবুর নামে রয়েছে কোলকাতার একটি বিখ্যাত রাস্তা... রাসবেহারি এভেনু, আর দুটো রাস্তাই কিন্তু বেশ কাছাকাছি!
এবার আসা যাক জায়গাটার নাম ঘড়িঘর হলো কি করে! সামনে চারটি ও পিছনে চারটি ডোরিক কলাম (Doric Column) যুক্ত এই তোরণটির মাথায় ছিল একটি বড়ো ঘড়ি, এখন যার জায়গায় আছে একটি শুন্য ফোঁকর। এই ঘড়িটির নামেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় ঘড়িঘরের রাস্তা। পরবর্তীকালে কালে গেটটি সংস্কারের সময় ঘড়িটি সরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু লোকমুখে আজও জায়গাটি ঘড়িঘর নামেই বিখ্যাত... এমনকি বাস কন্ডাক্টরও হাঁক দেন... "ঘড়িঘর এসে গেছে!"
তথ্যসহায়তা: ইমামবাড়ার বৃদ্ধ কেয়ারটেকার চাচা, এবং অঞ্চলের কয়েকজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
তথ্যসূত্র:
indiankanoon.org/doc/565304/
টিপু সুলতানের মসজিদের বিষয়ে আরো জানতে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে
https://wp.me/pafk8k-6z
টিপু সুলতানের বোনের নামের মসজিদের কথা জানতে, ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে
https://wp.me/pafk8k-8z
পড়ে বেশ ভালো লাগলো। তোমার প্রতিটা লেখা বেশ তথ্যবহুল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো পড়ে।
ReplyDeleteThank you
DeleteAn amazing read for sure
ReplyDeleteThank you Ma'am!
Deleteকতবার ওদিকে গেছি, কখনো জানিইনি...সত্যি নিজের শহরকে কত কম চিনি।
ReplyDeleteThank you
Deleteঘড়িঘর দেখেছি আর গেছি ও ওই পথ দিয়ে ভিতরে। ভিতরে ওরকম একটা জায়গা আছে বাইরে থেকে একেবারে বোঝা যায়না। ইমামবাড়া দেখে তাই খুব অবাক হয়েছিলাম। আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।ভালো লাগলো এই ইতিহাস ফিরে দেখা কে।
ReplyDeleteভালো লাগলো রে লেখাটা...
ReplyDeleteThank you 😊
Deleteযাওয়ার ইচ্ছে রইল। ইমামবাড়াতে যে লাল রং ব্যবহৃত হতে পারে তা সত্যিই আশ্চর্যের।
ReplyDeleteলাল রঙের বিষয়টা আমিও খেয়াল করি নি!
Deleteভালো লাগলো,আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
Deleteখুব ভালো লাগলো,তথ্য বহুল আলোচিত
ReplyDeleteঅনেক অজানা কথা আমাদের জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ
ReplyDeleteএই লেখা পড়ে যেমন অজানা কে জানি তেমনই ভাবতে লজ্জা হয় যে নিজের শহর সম্পর্কে কত কম জানি ।
ReplyDeleteদারুন ভালো লাগলো
ReplyDeleteঘড়িঘরের কথা জানি।তবে এই ইমামবাড়া র দিকে যাওয়া হয়নি।আমাদের টালিগঞ্জ অঞ্চল খুবই সমৃদ্ধ।কিছু জানি অনেকটাই জানিনা।তোমার লেখা সেগুলোতে আলো দিয়েছে। পুরোটা জানা হলো।ধন্যবাদ।
ReplyDeleteVery informative information. Thanks for sharing.
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো এই ইতিহাস জেনে সলিল। অনেক ধন্যবাদ। 🙏
ReplyDeleteসুন্দর তথ্য সমৃদ্ধ একটি পরিবেশনা। কিছু তথ্য জানাই থাকলেও বেশিরভাগ তাই অজানা ছিল।
ReplyDelete