চিংড়িখালি দূর্গ, ডায়মন্ড হারবার : এক ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থাপত্যের জনশ্রুতি ও সত্যতার গল্প (Chingrikhali Fort, Diamond Harbour : The Myth and Truth behind a Ruined Architecture)
আজ যে জায়গাটার কথা আমি বলছি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই অঞ্চলটা পিকনিক স্পট আর উইকেন্ড ডেস্টিনেশন হিসেবে বাঙালিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়! আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেই কোনো না কোনো সময়ে এখানে গেছেন, বিশেষতঃ দক্ষিণ কোলকাতার অধিবাসীরা।
অঞ্চলটা হলো ডায়মন্ড হারবার, যা ছিল এক সময়ে সুন্দরবনের অন্তর্গত, এবং পুরোনো নাম ছিল হাজীপুর। ইংরেজ আমলে সুন্দরবনে কিছু নতুন বন্দর বানানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ডায়মন্ড হারবার উল্লেখযোগ্য।
এবার ফিরে আসি বর্তমানে। এখানে যে পিকনিকের জায়গাটি রয়েছে, তার কাছেই রয়েছে একটি ভাঙা দূর্গ, যার কয়েকটা ভাঙা দেওয়াল শুধু বর্তমান, বাকিটা নদীগর্ভে ভাঙনের কবলে অবলুপ্ত হয়েছে। দূর্গটি কতটা বড়ো ছিল, সেটা বোঝা যায় নদীর তীরে বহুদূর পর্য্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কেল্লার ইঁটের ছোট ছোট টুকরোর বিস্তৃতি দেখলে।
এই দূর্গটা সম্পর্কে জনশ্রুতি রয়েছে, সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা এটি তৈরি করে, লুটের মাল রাখার জন্য। পরবর্তীকালে ইংরেজরা এটি সারিয়ে নিয়ে ব্যবহার করে, এবং নদীর পাড় ভাঙনের সাথে সাথে, এই দুর্গটি পরিত্যক্ত হয়। wikimapia তেও দেখলাম এই দূর্গ পর্তুগিজদের তৈরি বলেই উল্লেখ করা রয়েছে। আবার কয়েকজন আরেকধাপ এগিয়ে, দাবি করেছেন এটা ফরাসিদের তৈরি!
এবার আসি এর সত্যতা খোঁজার বিষয়ে। ২০১৯ সালে কর্মসূত্রে ডায়মন্ড হারবারে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত দূর্গ দেখার পর থেকেই, এর ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলাম। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, পর্তুগিজ জলদস্যুদের যে ধরণের জীবনযাত্রা ছিল, তারা লুটের মাল রাখার জন্য একটা ওতো বড়ো কেল্লা বানিয়ে ফেলবে, এবং তৎকালীন মুসলিম শাসকরা বিষয়টা মেনে নেবে... এটা ঠিক নেওয়া যায় না। আর ফরাসিদের বিষয়টা একেবারেই অসম্ভব!
এই অঞ্চলের এবং দূর্গের বিষয়ে যে লিখিত তথ্য পাওয়া যায়, তা বিভিন্ন সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ারে। ১৮১৫-র এবং ১৯১৪-র ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ারে এই দূর্গ ও অঞ্চল সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায় -
"At Diamond Harbour the Company’s ships usually unload their outward and receive the greater part of their homeward bound cargoes from whence they proceed to Sagar roads where the remainder is taken in." অর্থাৎ এখানেই ইংরেজদের পণ্যবাহী জাহাজগুলো লোডিং ও আনলোডিং হতো। এছাড়াও গেঁওখালি ও আসামগামী স্টিমারগুলো এই বন্দর ছুঁয়ে যেত।
বন্দরের সৃষ্টির সাথে সাথেই, ইংরেজরা হাজীপুরের নাম বদলে রাখে ডায়মন্ড হারবার। বন্দর হিসেবে তখন এই অঞ্চলের খুব ব্যবহার ছিল, তা বোঝা যায় গেজেটিয়ারের এই লেখায় -
"Diamond Harbour was a favourite Anchorage of the Company's ships in olden times. It suffered severaly in the terrible cyclone of 1864, which swept away large number of inhabitants. A harbour master and customs establishment are maintained to board vessel proceedings up the Hooghly, and the movement of shipping up and down are telegraphed to Calcutta and published, at intervals throughout the day, in the Calcutta Telegraph Gazette."
এতেই বোঝা যায়, কোলকাতা বন্দর চালু হবার আগে ডায়মন্ড হারবার বন্দরের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল, এবং আজও কোলকাতা বন্দরের জন্য যে স্যান্ডহেড (বন্দরে ঢোকার আগে জাহাজের অপেক্ষা করার জায়গা) ব্যবহার হয়, সেটা ডায়মন্ড হারবার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ডায়মন্ড হারবারেই ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই বন্দরকে শহরের সাথে যুক্ত রেখেছিল ইস্ট বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে, এবং ৩০ মাইল দীর্ঘ একটি বাঁধানো রাস্তা।
"Diamond Harbour is connected with Calcutta by a branch of the East Bengal State Railway, and a metalled road 30 miles long."
ডায়মন্ড হারবারে অনেক সরকারি অফিস তো গড়ে উঠেছিল, মজার কথা হলো একটি ছোট কয়েদখানাও ছিল এখানে!
"Diamond Harbour contains the usual public offices; the sub jail has accommodation of 12 prisoners."
এবার আসি দূর্গের প্রসঙ্গে। ১৮৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পোর্টের থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ইংরেজরা তৈরি করে এই দূর্গ। দূর্গটা সুরক্ষিত করার জন্য ব্যারাকপুর থেকে সম্ভবতঃ পাঁচটি কামান এনে, এখানে বসানো হয়... যার মধ্যে দুটি কামানের ভগ্নাবশেষ ২০১১ সাল নাগাদ পাওয়া গিয়েছিল।
"A mile to the south is Chingrikhali Fort, where heavy guns are mounted and the Artillery from Barrackpore encamp annually for gun practice."
দূর্গ তৈরীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে বন্দর-রক্ষা, ও সাথে নুনের ব্যাবসা... কারণ এই দূর্গ তৎকালীন সময়ে নিমক-রাজস্ব বিভাগের প্রধান অফিস ছিল। এছাড়াও মক্কা থেকে যেসব তীর্থযাত্রীরা ফিরতেন, তাদের জন্য একটা পৃথকীকরণ শিবির (Quarantine Camp) ছিল এখানে।
"It is the Head-quarters of the Salt Revenue Department; and a quarantine station has been opened for the accommodation of pilgrims returning from Mecca."
বিগত চার দশকে নদীর পাড় ভাঙার দরুণ এই দূর্গ ক্রমশঃ লুপ্ত হচ্ছে, আর নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। আমার একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল, দূর্গের কোনো পুরোনো ছবি... যাতে দূর্গের আসল রূপটা বোঝা যায়, সেটা পাই নি। ভবিষ্যতে জোগাড় করতে পারলে, ব্লগে সংযুক্ত করে দেব। আরেকটা জিনিস দেখে বেশ মজা লাগলো, ওই ভাঙা ভিতের ওপরে কেউ একজন ঠাকুরের মূর্তি বসিয়ে দিয়ে গেছে!
বিশেষ সহায়তা: অমিতাভ পুরকায়স্থ
তথ্যসূত্র:
১. dsal.uchicago.edu/reference/gazetteer/text.html?objectid=DS405.1.I34_V11_346.gif
২. timesofindia.indiatimes.com/travel/diamond-harbour/diamond-harbour/ps47954490.cms
৩. archives.anandabazar.com/archive/1110711/11south-letter.html
৪. telegraphindia.com/amp/states/west-bengal/fear-on-the-diamond-harbour-waterfront/cid/1701242
৫. sahapedia.org/portuguese-bengal-history-beyond-slave-trade
৬. wikimapia.org/478026/Old-Portuguese-Fort
৭. www.tripoto.com/trip/in-search-of-chingrikhali-fort-2330
Excellent research work.
ReplyDeleteThank you!
DeleteWow !!! Nice article !! Love it 😍
ReplyDeleteSuperb coverage
ReplyDeleteThank you!
Deleteঅনেক কিছু জানতে পারলাম, ধন্যবাদ।
ReplyDeleteThank you!
DeleteThank for the excellent piece. Want to know more about such structures in Sundarban
ReplyDeleteThank you Very much!
Deleteআপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই তথ্যটি জানাবার জন্য। ডায়মন্ড হারবারের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জেনে ভালো লাগলো।
ReplyDeleteডায়মন্ড হারবার সম্পর্কে আরেকটি অজানা/স্বল্প-জানা তথ্য হলো, ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন ডায়মন্ড হারবার আর কলকাতার মধ্যে চালু হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Telecommunications_in_India
Thank you!
DeleteFirst I must appreciate your attempt and then your attitude to disclose your sources. Thank you.
ReplyDeletePleasure is mine!
Deleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে l এই স্থানের সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য l আপনার খোঁজ ও সন্ধানের প্রয়াস দেখে সত্যি অভিভূত হলাম l
ReplyDeletePleasure is mine!
Deletepurano pic dekhar jonno khuv utsahito...... THANK YOU
ReplyDeleteআমি গোটা দুর্গের একটা ছবির সন্ধানে আছি।
Deleteঅনেকে যে বলে হ্যামিলটন সাহেব এর সঙ্গে যুক্ত, সেটা কী ভুল?
ReplyDelete