নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)
আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। কলকাতা তখনো আজকের কোলকাতা হয় নি। হুগলীনদীর গতিপথও ছিল অন্য। আজকে জোড়াবাগান চারমাথার ক্রসিংয়ের (Jorabagan Four Point Crossing) থেকে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের (Nimtala Ghat Street) দিকে এলে যে অষ্টাদশ শতাব্দীর আনন্দময়ী কালীমন্দির (Anandamayi Kali Temple) আছে, তার কাছেই বয়ে যেত গঙ্গা। মন্দিরসংলগ্ন অঞ্চলেই গঙ্গার উপরে ছিল সেখানকার ধর্মপ্রাণ জমিদার মহম্মদ রমজান আলীর (Muhammad Ramzan Ali) এক পূর্বপুরুষ নিয়ামাতুল্লার (Niyamathullah) তৈরি ঘাট, যা তখনকার হিন্দু ও মুসলমানরা দুজনেই ব্যবহার করতো। এদের পরিবার এই অঞ্চলে এসেছিলেন বহু আগে, তাদের অনেক পরে হাটখোলার দত্তরা এই অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন।
সেদিনটার সকালটা ছিল অন্যদিনের মতোই। তর্করত্নমহাশয় তার দুই ছাত্রের সাথে গঙ্গাস্নান সেরে, গঙ্গার ঘাটে আহ্নিকে বসেছেন। লোকজন স্নান সেরে ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় রমজান আলীর বাড়ির কিছু বাচ্চা ছেলে এলো চান করতে, সাথে বাড়ীর পুরোনো ভৃত্য ফজলু। কিছুক্ষণ নদীতে হুটোপাটি করার পর ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে জল ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। কিন্তু অসাবধানতা-বশতঃ, সেই জলের ছিটে গিয়ে লাগলো আহ্নিকে মগ্ন তর্করত্নমহাশয়দের গায়ে!
শিউরে উঠলেন তিনজনেই! তর্করত্নমহাশয় তাকিয়ে দেখলেন, কে এই কাজটা করেছে! বেগতিক দেখে, বৃদ্ধ ফজলু হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল ওনাদের কাছে। পন্ডিতমহাশয় শুধু বললেন -
"মুসলমানের ঘাটে হিন্দুর স্নান-পূজা করার এই ফল! চলো আবার অন্য ঘাটে গিয়ে পূজা করতে হবে।" এই কথা বলে তিনজন অত্যন্ত রুষ্টচিত্তে বেরিয়ে গেলেন ঘাট থেকে।
দুপুরের খাবারের পরে, আরামকেদারাতে শুয়ে গড়গড়া টানছিলেন আর একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রমজান আলী। এমন সময় ভৃত্য ফজলু এসে পুরো ব্যাপারটা নিবেদন করলো তার কাছে।
গড়গড়া নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন আলীসাহেব। তারপর হুকুম দিলেন -
"নায়েবমশাইকে খবর দে।"
নায়েব এলে আদেশ করলেন - "চারিদিকে ঘোষণা করে দিন, আজ থেকে আমাদের ঘাট শুধু হিন্দুরাই ব্যবহার করতে পারবে। পাহারা বসান আজ থেকেই, যাতে কোনো মুসলমান ঘাট ব্যবহার করতে না পারে।"
ধার্মিক রমজান আলীর ওরফে রমজান উস্তাগরের এরকম দৃষ্টিভঙ্গী, তৎকালীন পুরোনো কোলকাতায় সমাজবদ্ধতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
ফিরে আসি আজকের সময়ে। নিয়ামাতুল্লার ঘাটও নেই, আর গঙ্গাও এখন অনেক দূরে, আরো পশ্চিমে চলে গেছে। আনন্দময়ী কালীমন্দিরের ডানদিকে এখন একটা প্রায় ৯ ফুট উঁচু ভিতের উপরে মসজিদ দেখা যায়। এতো উঁচুতে মসজিদ তৈরি করার কারণ, গঙ্গার জলে যাতে ধর্মস্থান ভেসে না যায়। মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন সেই রমজান আলী, যার কথা বলেছি একটু আগেই। সেই লুপ্তঘাটের নামে এই মসজিদ... নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদ (Niyamathullah Ghat Mosque)। ঠিকানাটা হলো ৮৬/১ নিমতলা ঘাট স্ট্রীট, কোলকাতা - ৭০০ ০০৬।
মসজিদের বিবরণ বলার আগে একটা কথা বলে নি। এর উঁচু ভিতের মধ্যে দিয়ে ছিল সুড়ঙ্গ, যা দিয়ে সেই ঘাটে আসার রাস্তা ছিল। ভিতের লাগোয়া দোকানগুলোর ছাদ অর্ধবৃত্তকার, অনেকটা সুড়ঙ্গের রাস্তার মতো। লাগোয়া রাস্তাটির নামও মহম্মদ রমজান লেন। মসজিদের দেওয়ালে আগে একটি পাথরের ফলক ছিল, যাতে উল্লিখিত ছিল এর স্থাপনাকাল হিজরী ১১৯৯ সালে (ইংরেজি ১৭৮৪ সালে)।
নয়টি গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের দরজা দিয়ে ঢুকেই রয়েছে একটি কল লাগানো বড়ো জলের ট্যাংক, যেখানে হাত পা ধুয়ে, পোড়ামাটির টালির ১৭টি সিঁড়ি বেয়ে ভিত্তিভূমিতে পৌঁছাতে হয়। এই ভিত্তিভূমি তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়ের নির্মাণশৈলীতে চুন-সুরকির মিশ্রণ পিটিয়ে, যা আজও অটুট। প্রতিটি গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে প্রস্ফুটিত পদ্মের নকশা, যার মাঝখান থেকে উঠে গেছে তীক্ষ্ণ চূড়ো। তিনটে খিলানওলা এই মসজিদের প্রবেশপথ হলো মাঝের খিলানটি, আর রয়েছে চার প্রান্তে চারটি সুউচ্চ মিনার, যা আটকোণি নির্মাণরীতিতে বানানো। এই মিনারগুলো এমনভাবে বানানো, যেন আলাদাভাবে মসজিদের ভিতের লাগোয়া দেওয়ালের সাথে সাথেই উপরে উঠে গেছে। মসজিদে কুলুঙ্গির উপস্থিতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মত, প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা মন্দিরের পাথর ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। এমনিতে মসজিদটির ভিতরটি বিশেষ নকশাযুক্ত না। তবে এটা বলা যায়, বঙ্গীয় মসজিদ স্থাপত্যশৈলীর এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন এই মসজিদ।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললে, লেখাটা সম্পূর্ণ হয় না... সেটা হলো নিমতলা ঘাটের নামকরণের কারণ। এই নিয়ামাতুল্লার ঘাট যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন এই নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের কোনো নাম ছিল না, একে বলা হতো জোড়াবাগানের রাস্তা (Road to Jorabagan)। সবাই এই রাস্তা দিয়েই যেত গঙ্গাস্নানে। তবে সেই সময় এই রাস্তাটা ঠিক পাকারাস্তা ছিল না। কিছুটা কাঁচারাস্তা, কিছুটা মাঠ, কিছুটা ধানক্ষেত... এরকম ছিল এই রাস্তাটা। নিয়ামাতুল্লা ঘাটের উত্তরদিকে ছিল অনেকগুলো বড়ো বড়ো নিমগাছ। ইংরেজি ১৬৮৬ সালে হুগলী থেকে তাড়া খেয়ে, জব চার্নক জলপথে এই নিমগাছগুলোর নিচেই এসে ওঠেন, এবং আটচালা তৈরি করে থাকতে শুরু করেন।
উপরে বর্ণিত ঘটনার উপরে ভিত্তি করে, নিমতলা নামকরণের পিছনে দুটি যুক্তি উঠে এসেছে।
প্রথমতঃ, নিয়ামাতুল্লার ঘাট থেকে অপভ্রংশ হয়ে নিমতলা ঘাট।
দ্বিতীয়তঃ, যে নিমগাছগুলোর নীচে জব চার্নকের থান গেড়েছিলেন, সেই নিমগাছগুলো থেকেই নিমতলা।
সত্যি যুক্তিটা যে কি... সেটা জব চার্নক এবং নিয়ামাতুল্লার সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
১. কলকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য প্রবন্ধ : প্রাণকৃষ্ণ দত্ত
২. কৌশিকী '৯৬, নিমতলা : দেবাশীষ বসু
৩. কলকাতার মন্দির-মসজিদ, স্থাপত্য-অলংকরণ-রূপান্তর : তারাপদ সাঁতরা
৪. কলকাতার উপাসনালয়, দ্বিতীয় খণ্ড : পীযূষকান্তি রায়
দারুণ। আমি মোটা মহাদেব মন্দির দেখতে চাই মন্দিরের রাস্তার নাম জানলেই রমজানকে কেউ উত্তর দিতে পারল না এমনকি কাউন্সিলর সুধাংশু ছিলনা অবস্থাটা বুঝতে পারছো অথচ তোমার লেখা থেকে সব উত্তর পেলাম।
ReplyDeleteThank you!
Deleteআমি মোটা মহাদেব মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম রাস্তাটার নাম মোঃ রমজান লেন। রমজান কে তা জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। এমনকি পুরনো কাউন্সিলর সুধাংশু শীল ও দিতে পারেনি। এবার জানলাম অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅসাধারণ !!! খুব ভালো লাগলো পড়ে 😊😊
ReplyDeleteThank you!
Deleteনিমতলা ঘাট শশ্মানের পাশ দিয়েই তো গঙ্গা ওরফে হুগলী নদী বয়ে চলেছে। এই মসজিদ কি শশ্মানের আরও পূর্ব দিকে? কারন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গঙ্গা আরও পশ্চিম দিকে সরে গেছে!!!
ReplyDeleteপূর্ব-পশ্চিম এভাবে গুলিয়ে যাচ্ছে! সোজা করে বলি। 😊
Deleteমসজিদের লাগোয়া ছোট রাস্তাটার উপর ছিল ঘাট, সেখানেই ছিল নদী। নদীর লাগোয়া শ্মশান, আর সেখানেই শ্মশানকালিমন্দির। তখন স্ট্যান্ড রোড হয় নি।
পরে আরো পিছনের দিকে সরে যায় নদীর গতিপথ।
কলকাতার কত অজানা কথা তোমার লেখা থেকে জানতে পারি। তোমার সাথে সাথে তোমার চোখ দিয়ে পুরো কলকাতা দেখতে পাই। কৃতজ্ঞ তোমার কাছে
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ
DeleteEi masjid tai amio ghure es6i. Er j erokm itihas joriye a6e tokhn jdi jantam! A6a Ekta kotha bolun ekhne meyeder prabesh ki baron ? Jdi nahoi thle bondhutter Nye jawa Jai.
ReplyDeleteঅসাধারণ লাগলো পুরনো কোলকাতার ইতিহাস।সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteAnek kichu jante parlam tmr lekha theke.
ReplyDeleteApoorbo
ReplyDeleteদারুণ লাগল। কত কিছু যে জানার আছে। আপনার লেখা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ইতিহাস ভেসে উঠলো।
ReplyDelete