কোলকাতার প্রাচীনতম স্কটিশ চার্চ, আর সম্মানের লড়াইয়ের গল্প (Calcutta's Oldest Scottish Church and story of ego clash)

বাঙালির পুরোনো অফিসপাড়া হলো ডালহৌসি স্কোয়ার অঞ্চল, অধুনা বি.বি.ডি. বাগ। এই অঞ্চলের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি শ্বেতশুভ্র চার্চ, যার সামনে আছে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট, বামদিকে রাইটার্স বিল্ডিং, আর ডানদিকে লালবাজার। চার্চটির নাম সেন্ট এন্ড্রুজ চার্চ (St Andrew's Church, also known as the Kirk), ঠিকানা ১৫নং বি.বি.ডি. বাগ, কোলকাতা - ৭০০ ০০১



সেন্ট এন্ড্রুজ ছিলেন প্রভু যীশুর ১২ জন শিষ্যদের মধ্যে একজন। যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং ফিরে আসার কিছুদিন পরে, সেন্ট এন্ড্রুজ বেরিয়ে পরেছিলেন প্রভুর বার্তা প্রচার করতে। অনেক জায়গা ঘুরে, করিন্থ উপসাগরের তীরে পাট্রাস নগরে এসে, তিনি ধর্মপ্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হন, এবং ওনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (ক্রুশে বিদ্ধ করে)।



কথিত আছে, স্কটল্যান্ডের এক মন্দিরে তার অস্থি রাখা হয়, এবং স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা ওনাকে নিজেদের গুরু না সন্তরূপে (Patron Saint) গ্রহণ করে।



এবার এই চার্চের পত্তনের গল্পে আসা যাক। রেভারেন্ড ডক্টর জেমস ব্রাইস (Rv. Dr. James Brice) কোলকাতায় প্রথম স্কটল্যান্ডের প্রোটেস্টান্টদের সংগঠন শুরু করেন, ইংরেজি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। তখন তো আর চার্চটি ছিল না, তাই প্রথমে এশিয়াটিক সোসাইটি হলে, ও পরবর্তীকালে অন্যান্য হলঘরযুক্ত জায়গায় প্রার্থনা করা হতো। পরে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে ৩০,০০০ টাকায় কেনা হয় এই বর্তমান চার্চের জমিটি (এছাড়াও সরকারপক্ষ থেকে ১,০০,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয় চার্চ তৈরির জন্য)। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই জমিতে এর আগে ছিল একটি পুরোনো কোর্ট, যেখানে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই কোর্টের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে ওল্ড কোর্টহাউস স্ট্রীট (Old Court House St.)।

আরেকটা কথা বলি, এখানে মেয়র্স কোর্ট ছিল না সুপ্রিম কোর্ট ছিল, সেটা নিয়ে জোর বিতর্ক আছে! আমি কিন্তু বলি... দুটোই ছিল! ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে মেয়র্স কোর্ট স্থাপিত হলেও, ১৭৭৪ এ এই একই জায়গায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি স্যার ইলাইজা ইম্পে নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ দেন।


৩০শে নভেম্বর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে খুব জাঁকজমক করে চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে রাজকীয় মর্যাদায় এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ময়রা (The Earl of Moira) এবং ওনার স্ত্রী ফ্লোরা ক্যাম্পবেল, কাউন্টেস অফ লওডাউন (Flora Campbell, 6th Countess of Loudoun)। এই কারণে এই গির্জাকে 'লাটসাহেব কা গির্জা'ও (Lat-Sahib-Ka-Girja) বলা হয় এই চার্চকে। চার্চের নির্মাণের দায়িত্বে ছিল মেসার্স বার্ন কুরি এন্ড কোম্পানি। ১৮১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর এই চার্চ জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, চার্চে আনা হয়েছিল 'এনহাৰ্মনিক অর্গান' ও পরবর্তীকালে 'গ্রে এন্ড ডেভিসন' কোম্পানির অর্গান, যা এখনো ব্যবহার হয়। স্কটিশ চার্চের কোনো গির্জার প্রার্থনায়, এরকম বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এই গির্জাই ছিল সম্ভবতঃ প্রথম।

বর্তমানে চার্চটি প্রোটেস্টান্টই রয়েছে, শুধু জুড়ে গেছে চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়ার সাথে। ছিমছাম চার্চটি অভ্যন্তরে দুতলা হলেও, এখন আর উপরে বসার ব্যাবস্থা নেই। একতলার হলঘরের দেওয়ালে দেখা যায় প্রচুর স্কটিশদের স্মৃতিফলক, যাদের অনেকেরই সমাধি রয়েছে কোলকাতার স্কটিশ কবরখানাতে। যদিও ভিতরে ছবি তোলা বারণ, তাও আমি লুকিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। চার্চের বাইরে সামনের দিকে কাস্ট-আয়রনের নকশা করা গ্রিল দিয়ে, খুব সুন্দর সীমানা করা আছে। জানতে পারলাম আগে পুরো চার্চের এলাকাটি এইরকম কাস্ট আয়রনের নকশা-করা গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেগুলো ক্রমশঃ চুরি হয়ে যাবার জন্য, এখন বাকি অংশটা পাঁচিল তুলে ঘিরে দেওয়া হয়েছে।



এবার আসি চার্চটির চূড়ো বানানো নিয়ে সৃষ্টি হওয়া এক সম্মানের লড়াইয়ের গল্পে, যা ছিল ইংলিশ চার্চ ও স্কটিশ চার্চ মন্ডলীর মধ্যে। রেভারেন্ড জেমস ব্রাইস এবং কোলকাতার প্রথম বিশপ থমাস মিডলটন (Thomas Middleton) একই জাহাজে করে কোলকাতায় এসেছিলেন। মজার কথা হলো, এদের দুজনের মধ্যে ছিল সাপ-নেউলের সম্পর্ক! ব্রাইসের পুরোনো চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি কোলকাতাতে দুজনকেই শত্রু মনে করতেন... এক হলো কোলকাতার গরম, দ্বিতীয় হলো বিশপ মিডলটন! অপরপক্ষেরও একই অবস্থা ছিল!

এবার মিডলটন যখন জানতে পারলেন, ব্রাইস সেন্ট এন্ড্রুজ চার্চের চূড়ো সেন্ট জনস চার্চের থেকেও উঁচু করার মতলব করছেন, তখন তিনি উঠে-পড়ে লাগলেন সেটা বানচাল করার জন্য। এই ঘটনা জানতে পেরে, ব্রাইসের মাথায় জিদ চেপে গেল। তিনি মনস্থির করলেন, চার্চের চূড়ো তো উঁচু হবেই, তার সাথে চূড়োর শীর্ষে বসাবেন একটা ধাতব মোরগ, যা আরো ভালোভাবে বিশপের দর্পচূর্ণ করবে! মোরগটা কিন্তু ব্রাইস বসিয়েই ছাড়লেন!

এবার তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা করেন কি! তাঁরা তো কাউকেই চটাতে পারবেন না! তাই বিশপ মিডলটনকে একটু মলম লাগানোর জন্য তাঁরা একটা নির্দেশ জারি করলেন -
".... though the rest of the building might be repaired, this audacious bird should not have the benefit of the public works department."

এরপরে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন... সেই মিডলটনও নেই, আর ব্রাইসও নেই। কিন্তু পুরোনো কোলকাতার সেই হাস্যকর অহংবোধের লড়াইয়ের স্মৃতি বহন করে, মোরগটি আজও চূড়ার শীর্ষে ছিল অক্ষত অবস্থায়। কিন্তু ২০২০ খ্রিস্টাব্দের 'আমফান' ঝড়ে সেই মোরগটি ভেঙে পড়ে। ২০২২ সালে আবার সেই মেরামত করে, নতুন করে বসানো হয়।


তথ্যসূত্র:
১. কলকাতার উপাসনালয়, দ্বিতীয় খন্ড : পীযুষকান্তি রায়।
২. The Changing Face of Calcutta, An architectural approach, Calcutta 300 : Dr. S. C. Mukherji
৩. standrewschurchkolkata.in/
৪. heritagestructurewb.blogspot.com/2012/05/st-andrews-church-above-picture-was.html?m=1
৫. cnicalcutta.org/church_st_andrews_church.html

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)