কাটরা মসজিদ, মুর্শিদাবাদ (Katra Masjid, Murshidabad)

মুর্শিদাবাদ নামটা শুনলেই আমাদের আসে হাজারদুয়ারীর কথা। ইংরেজ আমলের শুরু হওয়ার আগে, সুবে বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ।

মুর্শিদাবাদ নিয়ে লিখতে শুরু করলে, প্রথমেই বলা উচিত মুর্শিদকুলি খান এবং তার প্রতিষ্ঠিত কাটরা মসজিদ নিয়ে। পূর্বে মুর্শিদাবাদের নাম ছিল মাকসুদাবাদ, পরবর্তীকালে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের নামে যা বদলে করে দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদ। 

মুর্শিদকুলি ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল বুরহানপুরের এক হিন্দু বংশে। একজন বণিক হাজী ইস্পাহানি তাকে ক্রীতদাস হিসেবে কিনে নিয়ে যান, ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং নাম দেন "মহম্মদ হাদী"। পুত্রস্নেহে হাজীর কাছে বড়ো হতে থাকেন তিনি, এবং উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে পারস্যে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে ভারতে ফিরে, ঢাকায় তিনি দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন, এবং ঔরঙ্গজেব তার নাম দেন করতলব খাঁ। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার সুবাদার আজিম-উশ-শানের সাথে শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে মতানৈক্য ঘটলে, করতলব খাঁ তার রাজস্ব বিভাগ, ঔরঙ্গজেব অনুমতি নিয়ে মাকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। এর ফলে তার অভিজ্ঞতায় সুবে বাংলার থেকে প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ হতে থাকে, এবং ঔরঙ্গজেব খুবই সন্তুষ্ট হন। কিছুদিনের মধ্যেই সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকার থেকে বদল করে মাকসুদাবাদে আনা হয়, এবং করতলব খাঁয়ের নতুন নাম দেওয়া হয় মুর্শিদকুলি খান। এই নামেই মাকসুদাবাদের নাম বদলে রাখা হয় মুর্শিদাবাদ। এরপরে ১৭১৬-১৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, তিনি সুবে বাংলার নাজিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আর তার সাথে হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নবাব। 

হাজারদুয়ারি থেকে দুই কিমি পূর্বে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির মসজিদ।  মুঘল স্থাপত্যরীতিতে মুর্শিদকুলি খানের নির্দেশে তার বিশ্বস্ত কর্মচারী মোরাদ ফরাস এক বৎসরের মধ্যে এই মসজিদ নির্মাণ কার্য শেষ করেন। মসজিদের পশ্চিমদিকে একটি বাজার ছিল, সেখান থেকে এর নাম হয়েছে কাটরা মসজিদ। মসজিদটি তৈরী হয়েছে একটি বিরাট বড়ো চাতালের ওপরে এবং তাকে ঘিরে আছে অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর। মসজিদের মূল প্রবেশদ্বারে পৌঁছতে হলে ১৪টি সিঁড়ি বাইতে হয়, যে সিঁড়ির নিচেই রয়েছে ধর্মপ্রাণ মুরশিদকুলি খাঁয়ের সমাধি। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই রয়েছে বিরাট চত্বর, যেখানে বর্গাকার খোপকাটা রয়েছে (নামাজের সুবিধার্থে)। এখানে বসে অনেক মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। 

মসজিদের পাঁচটি গম্বুজ ছিল, যার মধ্যে ভূমিকম্পের পর এখন শুধু দুটি অবশিষ্ট রয়েছে। মসজিদের প্রবেশের পাঁচটি খিলান রয়েছে, যাতে রয়েছে কালো পাথরের ব্যবহার। মাঝের খিলানের ওপরে একটি ফলকে ফারসি ভাষায় লেখা আছে "আরবের মহম্মদ, যিনি দুই জগতের গৌরব, তাঁর পায়ের ধুলো যেন তাঁদের মাথাতেও পড়ে, যারা তাঁর দরজার ধুলো হতে পারলেন না” - হিজরী ১১৩৭ (অর্থাৎ ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দ)। 

মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৪০ মিটার এবং প্রস্থে ৮ মিটার। মসজিদের চারদিকে চারটি ২২ মিটার উঁচু মিনার থাকলেও, বর্তমানে ভূমিকম্পের ফলে মাত্র দুটি অবশিষ্ট আছে। এই মিনারে ওঠার জন্য ভিতরে সিঁড়ি থাকলেও, দরজা বন্ধ থাকায় সেখানে ঢুকতে পারি নি।

মসজিদের চারদিকে যে ছোট ছোট ঘরগুলো দেখা যায়, সেগুলো তীর্থযাত্রী এবং কোরআন শিক্ষাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত হতো। আজকের তারিখেও, মুর্শিদাবাদের সবথেকে বড় ধর্মীয় স্থাপত্য হলো এই কাটরা মসজিদ। 

বর্তমানে এই মসজিদটি ASI এর অধীনে, এবং ঢুকতে দর্শনার্থীদের কোনো টিকিট লাগে না। তবে স্থানীয় গাইডরা প্রচুর ভুলভাল তথ্য দিয়ে থাকেন, যেমন হিন্দু মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল (সম্পুর্ণ ভুল কথা, কারণ মুর্শিদকুলি খাঁ অনেক মন্দিরের জন্য জায়গা দান করেছিলেন), এবং এই মসজিদের দক্ষিণদিকে একটি শিব মন্দির বানিয়েছিলেন ও সেখানে পুজো করতেন (এই মন্দিরটি একদম হালেই তৈরী হয়েছে, সেটা স্থাপত্যরীতি দেখলেই বোঝা যায়)।

Comments

Popular posts from this blog

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)

কোলকাতার পার্সি অগ্নি-মন্দিরগুলোর গল্প (The Parsi Fire Temples of Kolkata)

নতুন কোলকাতার পুরোনো ভুতেদের গল্প (Story of the Old Ghosts of New Calcutta)