কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ী ও ছোট রাজবাড়ী, মুর্শিদাবাদ (Cossimbazar Boro Rajbari and Choto Rajbari, Murshidabad)
মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার অঞ্চলটি একটি সময় ছিল সমৃদ্ধশালী ব্যবসায় কেন্দ্র। ইউরোপিয়ান বণিকদের কুঠি স্থাপিত হয়েছিল এখানে। এখানে রয়েছে দুটি রাজবাড়ী (প্রকৃতপক্ষে জমিদারবাড়ি), যা কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ী ও ছোট রাজবাড়ী নামে পরিচিত। তবে বড়ো ও ছোট মানে এই নয়, যে একই পরিবারের জমিদারী, বরং দুটো আলাদা পরিবারের সাথে জড়িত।
আজকের আলোচনায় জেনে নেওয়া যাক, এই দুটো রাজবাড়ী এবং তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে।
কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ী:
শ্রীপুর অঞ্চলে এই প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেন শ্রী কৃষ্ণকান্ত নন্দী। তার বাবা শ্রী রাধাকান্ত ছিলেন মুদি দোকানি, এবং কৃষ্ণকান্ত এই পারিবারিক ব্যবসায় যোগদান করেন। কাশিমবাজার ইংরেজ কুঠিতে তারা মুদিসামগ্রী সরবরাহ করতেন। সেই সময় থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাথে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ যখন কাশিমবাজার কুঠি আক্রমণ করেন, সেই সময় হেস্টিংস এই কৃষ্ণকান্তের কাছে আশ্রয় নেন। শোনা যায়, তাদের মুদি দোকানের মধ্যেই হেস্টিংস লুকিয়ে ছিলেন। এছাড়াও তাকে পালাতেও সাহায্য করেছিলেন নন্দী। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীকালে হেস্টিংস যখন গভর্নর জেনারেল হন, সেই উপকারের প্রতিদানস্বরূপ তিনি কৃষ্ণকান্তের ছেলে লোকনাথ নন্দীকে রায়বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন। এছাড়াও রংপুর জেলার বাহারবন্ধ পরগণার জমিদারী রানী ভবানীর থেকে নিয়ে, লোকনাথ এর নামে করে দেন। এর ফলে মুদি পরিবার থেকে নন্দীরা জমিদার পরিবারের পরিণত হন।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই বিরাট প্রাসাদটি প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণকান্ত। শোনা যায় কাশীর রাজা চেত সিংয়ের প্রাসাদ থেকে থাম, খিলান ইত্যাদি খসিয়ে নিয়ে এসে, তিনি এই বাড়িতে ব্যবহার করেন। রানী স্বর্ণময়ী এখানে তৈরী করিয়েছিলেন লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির। পরবর্তীকালে রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র প্রাসাদের সামনের গ্রীক স্থাপত্যের আর্চ ও থামগুলো তৈরী করান।
প্রাসাদটি বর্তমানে অনেকটাই খারাপ অবস্থায় আছে। এর ভিতরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ করা মানা। বিশেষ কেউ আর এখানে থাকেন না। প্রাসাদের সামনে একটি বড়ো ফোয়ারা ছিল, সেটিও আজ অবহেলায় শুকিয়ে পড়ে আছে।
কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়ী:
এই বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ফিরোজপুর অঞ্চলের রায় বংশের নাম। এই বংশের শ্রী অযোধ্যা রাম রায় কাশিমবাজার অঞ্চলে স্থাপন করেন। তবে ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে এই বাড়িটি তৈরী করান তার পুত্র দীনবন্ধু রায়। তবে তখনো এই পরিবার জমিদারিতে ছিল না। দীনবন্ধু রায়ের পুত্র জগবন্ধু রায় বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালেক্টর পদে চাকরি করতেন মেদিনীপুরে। সেই সময় তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রংপুর ও রসাইল পরগণার জমিদারী কিনে নেন। সময়ের সাথে সাথে তারা জমিদারী পরিবার হয়ে ওঠেন।
বর্তমানে জমিদারী প্রথা নেই। বাড়ীর সব সদস্যরাও কলকাতায় থাকেন। কিন্তু এই বাড়িটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করে, একটি হেরিটেজ হোটেল বানানো হয়েছে। এছাড়াও পর্যটকেরা টিকিট কেটে রাজবাড়ীর কিছুটা অংশ যা মিউজিয়াম করা হয়েছে, সেটি ঘুরতে পারেন। এখানে দুর্গাপুজো ধুমধাম করে পালিত হয়। এই বাড়ির একজন পুত্রবধূ শ্রীমতি সুপ্রিয়া রায় একটি বেকারী চেনের পত্তন করেন, যার নাম 'The Sugar and Spices'.
ছোট রাজবাড়ীর এই রমরমার কারণে, বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষেরাই কাশিমবাজার রাজবাড়ী বলতে ছোট রাজবাড়ীকেই জানেন। বড়ো রাজবাড়ী আর নন্দী পরিবারের ইতিহাস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে।
Comments
Post a Comment