পানিহাটি বারো শিব মন্দির ঘাট, সুখচর উত্তর চব্বিশ পরগণা (Panihati Baro Shiv Mandir Ghat, Sukhchar South 24Pgs)
উত্তর চব্বিশ পরগণাতে অবস্থিত পানিহাটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’-এ আমরা উল্লেখ পাই পানিহাটির। এখানে এতো বেশি নদীর ঘাট রয়েছে, যে ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় যতীন্দ্র মোহন দত্ত লিখেছিলেন, পানিহাটির মতো এতগুলো গঙ্গার ঘাট সম্ভবত বেনারস ছাড়া আর কোথাও নেই।
সেরকমই একটা ঘাট নিয়ে আজকে লিখছি আমি। সুখচর অঞ্চলে, হরিশ চন্দ্র দত্ত রোডে রয়েছে একটি সুদৃশ্য বড়ো ঘাট এবং সেটি লাগোয়া ১২টি শিবমন্দির। এটি পরিচিত বারো শিব মন্দির ঘাট হিসেবে। ঘাটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম পাওয়া যায় শ্রী নবীন চন্দ্র দত্তের, যিনি ছিলেন শ্রী হরিশ চন্দ্র দত্তর সুপুত্র। তবে এই ঘাট প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে একটি করুণ কাহিনী। গঙ্গানদীতে একদিন হরিশচন্দ্র তর্পণ করছিলেন। একজন গর্ভবতী মহিলা তখন কলসি করে জল তুলে আনার সময়, হঠাৎ ঘাটের খাড়া সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যান। দুর্ঘটনার ফলে ওনার গর্ভপাত ঘটে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মহিলার মৃত্যু হয়।
সম্পূর্ণ বিষয়টি ঘটে হরিশচন্দ্রের চোখের সামনে। তাই তিনি ব্যথিত হয়ে নিজের ছেলে নবীনচন্দ্রকে নির্দেশ দেন একটা এমন ঘাট বানানোর জন্য, যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য বিপজ্জনক হবে না। সেই অনুসারে ১২১৩ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে এই ঘাটটি নির্মিত হয়। একই সাথে নবীনচন্দ্র ঘাট লাগোয়া ১২টি শিব মন্দির (৬+৬) এবং একটি সুরম্য বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। নীলকান্তি কষ্টিপাথর (Black Basalt Stone) দিয়ে শিবলিঙ্গগুলো বানানো হয়; বাগানে শোভাবর্ধনের জন্য কয়েকটি ইউরোপিয়ান নারীমূর্তি ও সিংহমূর্তি বসানো হয়। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঘাট পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ স্থাপত্যের তকমা পায়।
এবার আসা যাক ঘাটের বর্ণনায়। সেই সময়ে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ইট, খয়ের, সুরকি এবং চিটেগুড়। ঘাটের সিঁড়িগুলো মাত্র চার ইঞ্চি উঁচু এবং যথেষ্ট প্রশস্ত। ঘাটের ওপরেই রয়েছে একটি পাঁচ খিলানের বৃহৎ চাঁদনী, যার নকশা করেছিলেন Sir Bradford Leslie এবং বানিয়েছিলেন প্রথম বাঙালি স্থপতিবিদ্ শ্রী নীলমণি মিত্র। ছাদে রয়েছে কড়িবর্গা, এবং প্রতিটি খিলানের ওপরে রয়েছে একটি ভিক্টোরিয়ান নারীমুখ, যার মাথায় আবার আলো রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বন্দরের তরফে কালনা থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত সমস্ত নদীঘাটগুলির সার্ভে করা হয়েছিল। সেই রিপোর্টে পোর্টের কমিশনার লিখেছিলেন "No other ghat down Kalna is so broad, so easy of ascent and so beautiful to look. It never turns dry even at the lowest ebb-tide."
এবার আসি বর্তমান সময়ে, ঘাট ও মন্দিরের বর্ণনায়। ঘাটের চাঁদনীর সংস্কারের ফলে অধিকাংশ কারুকার্য লোপ পেয়েছে, সাথে প্রতিষ্ঠাফলকটি বেপাত্তা! সুরম্য বাগানটি আর আজ নেই, সেখানকার মূর্তিগুলো আজ ভগ্নপ্রায়। শিবমন্দিরগুলোর সংস্কার বিভিন্ন সময়ে হয়েছে, সেই কারণে তিন রকম রং দেখতে পেলাম। তবে নতুন সংস্কারের নমুনা খুব খারাপ, কারণ শিব মন্দিরের গায়ের অলঙ্করণগুলো একেবারে মুছে, সিমেন্ট দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি শিবমন্দিরে এখনো কিছু পংখের কাজ দেখতে পাওয়া যায়। ঘাটে যাওয়ার পথেই একটি পুরোনো তুলসী মঞ্চ রয়েছে, যাতে কিছু কারুকার্য এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।
তবে একটা বিষয় দেখে খুব ভালো লাগলো। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই জায়গাটি সন্ধ্যার পরে অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে মন্দির কমিটির কড়াকড়ির ফলে মন্দির ও ঘাট চত্বর সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে, তারপর মূল প্রবেশদ্বার জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন এখানে বিকেলের দিকে প্রচুর বয়স্ক মানুষ আড্ডা এবং ধর্মচর্চার জন্য আসেন। আশা করা যাচ্ছে, ঘাটের এই পবিত্রতা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে।
তথ্যসূত্র: বারো মন্দির ঘাটের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ
Comments
Post a Comment