গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট, কলকাতা (Government College of Art and Craft, Kolkata)

কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলে রয়েছে ভারতীয় জাদুঘর। এর লাগোয়া যে পুরনো বাড়িটি রয়েছে, সেখানে রয়েছে গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট। এটি কলকাতার তথা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের অগাস্ট মাসে পথ চলা শুরু করেছিল কিন্তু বেসরকারিভাবে... চিৎপুরের গরানহাটা অঞ্চলের একটা বাড়িতে, ইংরেজ সার্জন ফ্রেডেরিক করবিনের নেতৃত্বে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, সব নতুন ছাত্রদের শিল্পকলাকে একটা নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিযুক্ত পদ্ধতিতে শেখানো। সেই বছরের নভেম্বরে, স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় কলুটোলা অঞ্চলে বাবু মতিলাল শীলের বাড়িতে। 


১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার এটা অধিগ্রহণ করে, এবং কলেজের নাম বদলে 'গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট' রাখা হয়। ওই বছরেরই ২৯ জুন হেনরি হোভার লক এর অধ্যক্ষ হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার কারণে, তিনি একটি সুষম শিল্পশিক্ষার সমর্থন করতেন, যেখানে ভারতীয় ছাত্রদের ইউরোপীয় শিল্পের মৌলিক আদর্শের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। শিল্প তৈরির ইউরোপীয় আদর্শ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে, লক এই আর্ট স্কুলে, লন্ডনের সাউথ কেনসিংটন স্কুলের সমার্থক শিল্প শিক্ষা প্রদানের উপর জোর দেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ১৬৬ নম্বর বউবাজার স্ট্রিটে এই স্কুলের স্থান বদল করা হয়। 

১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লক নিজপদে আসীন ছিলেন। লকের মৃত্যুর পর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর এম. স্কামবার্গ নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। এরই মধ্যে, এখানে সহকারী অধ্যক্ষের এক নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়, এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি ওই পদে ইতালীয় শিল্পী ও. গিলার্ডি যোগদান করেন।


১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রতিষ্ঠানকে পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত করা হয় চৌরঙ্গী অঞ্চলে, ভারতীয় জাদুঘর লাগোয়া এখনকার বাড়িতে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুলাই জোবিন্স আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল এই স্কুলের অধ্যক্ষরূপে যোগদান করেন। ইনি ছিলেন একজন ইংরেজ লেখক, শিল্প ইতিহাসবিদ এবং একজন প্রভাবশালী শিল্প প্রশাসক। ভারতীয় শিল্প ও স্থাপত্যের একজন মহান প্রবক্তা হওয়ার কারণে, তিনি ভারতে শিল্প শিক্ষার ধারণাটিকে পুনর্গঠনে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায়, হ্যাভেল শিল্পের ভারতীয় শৈলীকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে একটি শিল্প শিক্ষার পরিপন্থী ছিলেন। 


কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করে পার্সি ব্রাউন পরবর্তী অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ইংরেজ শিল্প ইতিহাসবিদ, শিল্পী, শিল্প সমালোচক, কিউরেটর এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ। একজন বিখ্যাত শিল্প ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক হওয়ার কারণে, পার্সি ব্রাউন ভারতীয় এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যের উপর ব্যাপকভাবে লিখেছেন। লাহোরের মেয়ো স্কুল অফ আর্ট-এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর, পার্সি ব্রাউন কলকাতায় আসেন এবং ১৯০৯ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট-এ অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট থেকে অবসর নেওয়ার পর, তিনি কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সেক্রেটারি এবং কিউরেটর হিসাবে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করেছেন। 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অগস্ট থেকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি একভারতীয় শিল্প ধারার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। এই ধারাই বঙ্গীয় শিল্প বিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছিল পরবর্তীকালে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় শিল্পের প্রতি হ্যাভেলের অদম্য উৎসাহের সাহায্যে কলকাতার আর্ট স্কুলে শিল্প শিক্ষার একটি বিকল্প মডেলের সূচনা করেছিলেন, যেটি পশ্চিমা একাডেমিকদের প্রচলিত মডেলের বিপরীতে 'ভারতীয়' হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এনার পরে বিশিষ্ট অধ্যক্ষ হিসেবে মুকুল চন্দ্র দে এবং চিন্তামণি কর এর নাম উল্লেখযোগ্য। 

এই সময়ের মধ্যে, কলেজটি দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে পশ্চিমা নান্দনিকতার পরিবর্তে ভারতীয় নকশা, ফলিত শিল্প, ঐতিহ্যগত হস্তশিল্প এবং আলংকারিক শিল্পগুলিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ফ্রেস্কো পেইন্টিং, বার্ণিশের কাজ এবং স্টেইনড-গ্লাস পেইন্টিংয়ের মতো কৌশলগুলি শেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি নতুন কোর্স চালু করা হয়েছিল।

এই স্কুল থেকে বেড়িয়েছেন অনেক বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী, যাদের মধ্যে নন্দলাল বোস, যামিনী রায়, ছত্রপতি দত্ত, শশী কুমার হেশ, লাইন সিং বঙ্গদেল, অতুল বোস, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী,সুভো ঠাকুর, অন্নদা মুন্সী, গোপাল ঘোষ, নীরদ মজুমদার, প্রাণকৃষ্ণ পাল, মুকুল দে, চিন্তামণি কর, মৃণাল কান্তি দাস, সত্যেন ঘোষাল, উপেন্দ্র মহারথী, মনু মুন্সী, সোমনাথ হোড়, রাজেন তরফদার, জয়নুল আবেদিন, রণেন আয়ন দত্ত, কুমকুম মুন্সী, হেমেন মজুমদার, হরেন দাস, শানু লাহিড়ী, শ্যামল দত্ত রায়, গণেশ পাইন, গণেশ হালুই, সুনীল দাস, বাঁধন দাস, সমীর মণ্ডল, অশোক ভৌমিক, যোগেন চৌধুরী, সুদীপ রায়, পুলক বিশ্বাস, নিরঞ্জন প্রধান, অনন্ত মণ্ডল, পরেশ মাইতি, অখিল চন্দ্র দাস, মৃণাল কান্তি রায়, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, সনাতন দিন্দা, সুমন্ত্র সেনগুপ্ত ও বিমান বিহারী দাস... প্রমুখ বিশেষভাবে শিল্পক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রেখেছেন।

বর্তমানে এই কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অধিভুক্ত হয়েছে। কলেজটি ভাস্কর্য, গ্রাফিক ডিজাইন, টেক্সটাইল, সিরামিক আর্ট এবং মৃৎশিল্প, নকশা (কাঠ এবং চামড়া) এবং চিত্রকলায় ব্যাচেলর অফ ফাইন আর্টস এবং মাস্টার অফ ফাইন আর্টস প্রোগ্রাম অফার করে থাকে। এখানে ২০০৫ সাল থেকে চারুকলায় ডক্টরেট ডিগ্রী দেওয়া শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় চিত্রকলায় বিশেষ কোর্স করার জন্য দেশের গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে এটি একটি। উপরন্তু, প্রতি বছর এটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন, কর্মশালা, বক্তৃতা এবং বার্ষিক প্রদর্শনীর মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। 

তথ্যসূত্রঃ
১. www.gcac.edu.in/
২. wikipedia.org/wiki/Government_College_of_Art_%26_Craft

Comments

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)