ইডেন গার্ডেন এবং বার্মিজ প্যাগোডা (Eden Garden and Burmise Pagoda)

কলকাতার বিখ্যাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম হলো ইডেন গার্ডেনস। অনেক ইতিহাস তৈরী হয়েছে এখানে। এর পাশেই রয়েছে একটি বিরাট সুসজ্জিত বাগান, যারও নাম একই! অনেকেই কিন্তু জানেন না, এই বাগানের নামেই কিন্তু স্টেডিয়ামের নাম রাখা! বাগানটার ইতিহাস নিয়েই বলবো আজকে।




অবিভক্ত ভারতের গভর্ণর জেনারেল হিসেবে জর্জ ইডেন তথা লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৬ - ১৮৪২ সাল পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওনার দুই বোনের নাম ছিল এমিলি ও ফ্যানি ইডেন, যারা দাদার কাছে কলকাতায় ঘুরতে এসেছিলেন। রাজভবনে এসে উঠলেও, রোজ দুই বোন নদীর ধারে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোতেন।




এমিলি বাগান করতে ভালোবাসতেন, এবং তার মধ্যে ছিল শিল্পী সত্ত্বা। তাই বোনদের কথায়, এই জায়গাতে বাগান তৈরির মনস্থ করেন লর্ড অকল্যান্ড। জনশ্রুতি আছে, এই জমিটি ছিল রানী রাসমণির। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ক্যাপ্টেন ফিজগেরাল্ডের তত্ত্বাবধানে ও নকশায়, এই বাগানের কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৮৪০ সালে। বাগানের নাম প্রথমে রাখা হয়েছিল 'অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন', কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লোকমুখে বাগানের নাম বদলে হয়ে যায় ' ইডেন গার্ডেন'।




ভিতরের বাগানটি খুবই সুন্দর, এখানে রয়েছে একটি সুদৃশ্য ফোয়ারা। কিন্তু যারা ভিতরে গেছেন, তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন একটি বিশাল কাঠের প্যাগোডাকে। এই প্যাগোডাটিও বেশ প্রাচীন। এটি কিন্তু আসলে কলকাতার জিনিষ না, এটি বর্মার (বর্তমানে মায়ানমার) প্রোম শহরে (Prome) তৈরী। বাগানের উত্তরদিকে, জলাশয় ঘেরা একটি জমিতে রয়েছে এই সোনালী ও লাল রঙের কাঠের প্যাগোডাটি।





ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে, প্রোম শহরের গভর্ণর ছিলেন Maung Honon, যার মৃত্যুর পরে ওনার বিধবা স্ত্রী Ma Kin এই প্যাগোডাটি বানান ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে, স্বামীর স্মৃতিতে। একটি প্রার্থনার ঘর হিসেবে এই প্যাগোডা তৈরী করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল একটি রত্নখচিত বুদ্ধমূর্তি। ১৮৫৩ সালে লর্ড ডালহৌসি প্রোমে গেছিলেন, সেখানে এই প্যাগোডা দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং এটি কলকাতায় নিয়ে আসবেন বলে মনস্থির করেন। গভর্ণরের আদেশ, তাই আর অমান্য করার কোনো উপায় রইলো না। প্যাগোডাটি টুকরো টুকরো করে খুলে নিয়ে, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ 'Shway Gong' করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ১৮৫৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর, রাখা হয় ফোর্ট উইলিয়ামে। এর পরে প্রায় তিনমাস ধরে, ১২জন বার্মিজ শিল্পী এই প্যাগোডাটি ধীরে ধীরে জোড়া দিয়ে ইডেন গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৬ সালে, যার জন্য খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০০০ টাকা।




এবার আসা যাক এই প্যাগোডার বর্ণনায়, যার পোশাকি নাম 'Tazaung'। লাল ও সোনালী রঙের এই কাঠের প্যাগোডাটি তিনটি ধাপে তৈরি হয়েছে, এবং সর্বোচ্চ ধাপের ওপরে আছে একটি তীক্ষ্ণ চুড়ো। পুরোটাই কাঠের সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা। এছাড়াও আঁকা রয়েছে রয়েছে নানান ধর্মীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের ছবি।




সময়ের সাথে সাথে প্যাগোডাটি জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, তাই ১৯৭০ সাল নাগাদ দার্জিলিং থেকে কিছু নেপালি কারিগরকে এনে সেটা মেরামত করা হয়। এরপরে ২০১৪ সাল নাগাদ আরেকবার মেরামত করা হয়। বর্তমানে গার্ডেনের কয়েকজন কর্মচারী সব সময় প্যাগোডার কাছেই থাকেন, আর একটা জিনিষ দেখে ভালো লাগলো যে, প্যাগোডার পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য ওনারা জুতো পরে ভিতরে যেতে বারণ করেন।



কলকাতায় অনেক দ্রষ্টব্য আছে, কিন্তু খুব কম মানুষ এই প্যাগোডাটির কথা জানেন। তাই যারা এই ব্লগটা পড়লেন, সবাইকেই অনুরোধ যে এই অনন্যসুন্দর স্থাপত্যটি দেখে আসবেন অন্ততঃ একবার।

তথ্য সহায়তা: শ্রী দিবেন্দ্যু ব্যানার্জী

তথ্য সূত্র:
১. bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%87%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%A8_%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%B8
২. anandabazar.com/west-bengal/kolkata/%E0%A6%B8-%E0%A6%B8-%E0%A6%95-%E0%A6%B0-%E0%A6%B6-%E0%A6%B0-%E0%A6%AE-%E0%A7%9F-%E0%A6%A8%E0%A6%AE-%E0%A6%B0-%E0%A6%A5-%E0%A6%95-%E0%A6%86%E0%A6%A8-%E0%A6%87%E0%A6%A1-%E0%A6%A8-%E0%A6%B0-%E0%A6%AA-%E0%A6%AF-%E0%A6%97-%E0%A6%A1-%E0%A6%B0-1.22886
৩. likealocalguide.com/kolkata/buddhist-pagoda-at-eden-gardens

Comments

Popular posts from this blog

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)

কোলকাতার পার্সি অগ্নি-মন্দিরগুলোর গল্প (The Parsi Fire Temples of Kolkata)

নতুন কোলকাতার পুরোনো ভুতেদের গল্প (Story of the Old Ghosts of New Calcutta)