কলকাতা আর্ট স্টুডিও : লিথোগ্রাফ শিল্পের এক অনবদ্য অধ্যায় (Calcutta Art Studio : A forgotten chapter in Lithograph Art)
বৌবাজারের বি. বি. গাঙ্গুলি স্ট্রীট দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ১৮৫/১ নাম্বারে একটা ঘুপচি দোতলা বাড়ি দেখা যায়, যেখানে আছে Calcutta Art Studio Pvt. ltd. এর অফিস। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এই সংস্থার জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে বোঝা যাবে না, এই ছোট্ট স্টুডিওটি একসময় প্রিন্টিং জগতে আলোড়ন এনেছিল।
উনিশ শতকে কালীঘাট চিত্রকলা ও কালীঘাটের পট, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কোলকাতার কালীঘাটের কালীমন্দিরের সংলগ্ন এলাকায় বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তীর্থযাত্রীরা তাদের নিজেদের এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য, তীর্থযাত্রার স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্ন এই পট ও ছবিগুলো নিয়ে যেতেন।
কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে, স্মারক হিসেবেই কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক-ধর্মীয় কাহিনী। কিন্তু ক্রমে তা ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়কেও তুলে ধরতে থাকে, এবং এতে সমসাময়িক সামাজিক বিষয়ের প্রতিফলনও লক্ষ্য করা যায়... যা এতদিন পর্যন্ত তীর্থক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট শিল্পকলার আওতা বহির্ভূত ছিল। এই চিত্রকলায় নতুন নাগরিক সমাজের মূল্যবোধ প্রতিফলিত ও উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জার্মানি থেকে সস্তা অলিওগ্রাফগুলি, কালীঘাট পেইন্টিংগুলি অনুলিপি করে এবং বিপুল পরিমাণে তাদের ব্যবসা শুরু করে। সস্তা প্রিন্টগুলি, হাতে আঁকা কালীঘাট পেইন্টিংগুলিকে প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেয়, এবং শিল্পীদের খুব সমস্যার সৃষ্টি করে। এই সময়েই কলকাতার আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা শিল্পীরা ভাবতে থাকেন একে একটি স্বদেশী শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। পত্তন করা শুরু হয় স্বদেশী আর্ট স্টুডিও, কার মধ্যে কলকাতা আর্ট স্টুডিও, ভারতীয় শিল্পের প্রচলিত প্রবণতাকে পরিবর্তন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
'কোলকাতা আর্ট স্টুডিও'র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম করা যায় অন্নদা প্রসাদ বাগচীর। বাগচী বারুইপুরের শিখরবালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, এবং তিনি ছিলেন রাজা রবি বর্মার সমসাময়িক। কিশোর বয়সেই তিনি জোড়াসাঁকোর নীলমণি মুখোপাধ্যায়ের খোদাইয়ের কাজ দেখে মুগ্ধ হন, এবং গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট -এ যোগদানের পর, তিনি কাঠ কাটা, লিথোগ্রাফি এবং অন্যান্য খোদাই কৌশল শিখেছিলেন। তিনি রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাথে ওড়িশায় এবং পরে বোধগয়াতে বহুদিন ধরে ভ্রমণ করেছিলেন এবং পরবর্তী গ্রন্থ, 'অ্যান্টিকুইটিস অফ ওড়িশা'র জন্য অনেক ছবি এঁকেছিলেন। বোধগয়া নিয়েও গবেষণার জন্য অনেক ছবি এঁকেছিলেন।
বাগচী তার সেরা প্রাক্তন ছাত্র নব কুমার বিশ্বাস, ফণীভূষণ সেন, কৃষ্ণচন্দ্র পাল এবং যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে 'কোলকাতার আর্ট স্টুডিও'টি তার বউবাজার স্টুডিওতে খোলেন। নতুন স্টুডিওতে তারা যে প্রধান কাজগুলি শুরু করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল তেল বা জলরঙে প্রতিকৃতি আঁকা। এছাড়াও হিন্দু পৌরাণিক ছবি ছাপানোর বিষয়েও তারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন, কারণ ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রতিযোগিতা ছিল। এই স্টুডিওর ব্যয়বহুল লিথোগ্রাফগুলি 'বটতলা' এবং অন্যান্য সস্তার প্রিন্টের কাঠের কাটার থেকে একেবারে আলাদা ধরণের ছিল, যা উত্তর কোলকাতার চিৎপুর এবং গরানহাটাতে বানানো হতো। এর কারণ, এগুলি এমন শিল্পীরা বানাতেন, যারা পশ্চিমি শিল্প কৌশলগুলির ব্যবহার সুনিপুণভাবে করতেন এই কাজে। আসলে, শিল্পীরা একাডেমিক কনভেনশন এবং পুরুষ দেবতাদের সাথে তাল মিলিয়ে ত্রিমাত্রিক পরিসংখ্যান (3 Dimension) তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন, এবং প্রায়শই দেখা যেত যে পুরুষ চরিত্রগুলো ক্রিস্টিয়ান ন্যাটিভিটি থেকে অ্যাপোলো চরিত্রগুলির মতো। আবার মহিলা চরিত্রের ক্ষেত্রে সেগুলো ছিল ড্রেসডেন মূর্তি বা গ্রীকধর্মীয় দেবী দ্বারা অনুপ্রাণিত।
১৮৭৯ সালে বাগচি 'স্কুল অফ আর্ট'-এর প্রধান শিক্ষক হিসাবে ফিরে যান, এবং তার চারজন ছাত্র কলকাতা আর্ট স্টুডিওর মালিক হন। আস্তে আস্তে অন্যরা স্টুডিওটি চালানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এবং পরবর্তীকালে নবো কুমার বিশ্বাস (১৮৪৯-১৯৩৫) স্টুডিওর সমস্ত শেয়ার কিনে নেন এবং এর মালিকানা বিশ্বাস পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। এখানে পোট্রেট বানানোর জন্য অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এসেছেন, কিন্তু তাদের তেমন রেকর্ড রাখা হয় নি। এদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ একজন ছিলেন, কারণ ওনার পোট্রেট জুড়ে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রাচীন লিথো প্রেস, এবং নবো কুমার বিশ্বাসের একটি ছোট তৈলচিত্র। যদিও মূল প্রিন্টগুলি ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে, তবুও পুরনো একরঙা ছবিগুলির ক্ষুদ্র ব্রোমাইড প্রিন্ট এখনও আছে।
ধীরে ধীরে ১৯৬০ সালের মধ্যে, প্রেসটি একটি অফসেট প্রিন্টিং হাউসে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে স্টুডিওর অন্যতম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শুভজিৎ বিশ্বাস। কোলকাতা আর্ট স্টুডিও শুধু এত বছর ধরে টিঁকে নেই, বরং সময়ের সাথে সাথে এটি পূর্ব ভারতের একটি সফল প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
(ব্লগে উল্লেখিত সমস্ত পেন্টিংগুলো ১৮৭৮ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে সৃষ্ট, এবং Calcutta Art Studio- এর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।)
তথ্যসূত্র: Official Website of Calcutta Art Studio Pvt. Ltd.
বিশেষ সহায়তা: চিত্রশিল্পী ও লেখক অসিত পাল
Excellent information
ReplyDeleteThank you
Deleteএ যেন সোনার খনির সন্ধান, পরিশ্রমের যোগ্য ফসল ।
ReplyDeleteশিল্পী নব কুমার বিশ্বাসের দেবী অন্নপূর্ণার ছবিটি খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। আমাদের বাড়িতে এই ছবিতেই আজও দেবীর নিত্য আরাধনা হয়। রং হালকা হয়ে গেছে। তাও খুবই সুন্দর।
ReplyDeleteThank you
DeleteExcellent information, and it's like time travel.
ReplyDeleteসুন্দর বর্ণনা ও অপরূপ চিত্রকথনে শহরের এক পরিচিত স্থানের এক অপরিচিত ইতিহাসের সাথে পরিচিতি হল। লেখক মহাশয়কে অনেক ধন্যবাদ 🙏
ReplyDeleteThank you
Deleteকত অজানাকে তুলে ধরিস, খুব ভালো লাগলো পড়ে।
ReplyDelete