দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রাচীনতম দেওয়ালচিত্রের গল্প (The story of only oldest Fresco at South 24 Parganas)

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মধ্যে দিয়ে যে শিয়ালদা-লক্ষীকান্তপুর ট্রেনটি চলে, সেটি দাঁড়ায় 'বহরু' নামের এক স্বল্পখ্যাত স্টেশনে। আজকাল জয়নগরের সাথে মোয়ার লড়াইতে লোকজন বহরুর নাম জানতে শুরু করেছে। অনেকেই কিন্তু জানে না, এই বহরুতেই এমন একটি জিনিস আছে, যা এই জেলাতে এক ও অদ্বিতীয়।


আদিগঙ্গার পশ্চিম-পাড়ে এই অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে, কৃষ্ণরাম দাস রচিত রায়মঙ্গলে। তখন এই অঞ্চলের পরিচিতি ছিল 'বড়ুক্ষেত্র' নামে।
- "সঘনে দামামা ধ্বনি শুনি রায় গুণমনি বড়ুক্ষেত্র বহিল আনন্দে"।

পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের জমিদার হন বসুরা, আর তারাই বহরু বাজারের কাছে স্থাপন করেন পাঁচটি আটচালা শিবমন্দির (প্রতিষ্ঠার সময় সম্ভবতঃ ১২৪৬ বঙ্গাব্দে)। ২০০৫ সালে এই মন্দিরগুলোর আমূল সংস্কার হবার পরে, এর প্রাচীনত্ব লোপ পেয়েছে।

মন্দিরগুলো থেকে অদূরেই রয়েছে মাঠের মধ্যে একটি চারচালা দোলমঞ্চ, যার উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট। এখানে রয়েছে ফ্যানলাইটের কাজ এবং তার সাথে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত সরু আয়নিক স্তম্ভের ব্যবহার। পুরো মঞ্চটি চুনকাম করে ১২টা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে!

দোলমঞ্চ ছাড়িয়ে আরেকটু এগোলে চোখে পড়বে বসুদের পরিত্যক্ত দুর্গাদালান ও শ্যামসুন্দর জিউ এর দালান মন্দির। পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি হয়ে যাওয়ায়, খুঁজতে একটু অসুবিধা হয়। প্রায় ২৫ ফুট উচ্চতার দক্ষিণমুখী দুর্গাদালানটি বহু পত্রাকৃতি পঞ্চখিলান ও অলিন্দযুক্ত। ছাদের একটা অংশ ধসে গেলেও, চুনবালির ফ্যানলাইটের কাজ ও ফেস্টুনের (পুষ্পমাল্য) কাজ এখনো চোখে পড়ে। তবে স্তম্ভগুলো বেশ মোটা ও বর্গাকার, যা ইউরোপীয় ধাঁচের একদমই না।

এবার আসা যাক সবথেকে মূল্যবান ঐতিহাসিক বিষয়ে। দুর্গাদালানের পাশেই রয়েছে একটি শ্যামসুন্দর জিউ এর দালান মন্দির, যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বসু পরিবারের নন্দকুমার বসু। মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে, এবং শেষ হয় ১৮২৫ এ।


নন্দকুমার বসু ছিলেন বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। তিনি কাশিমবাজারে রেশমকুঠি, পাটনার কুঠি ও কিছু সময় কোলকাতার কাস্টমস হাউসেও চাকরি করেন। শেষজীবনে জয়পুরের দেওয়ানও ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে চুনার ও জয়পুর থেকে মন্দির তৈরির জন্য নৌকা করে পাথর আনান তিনি।

মন্দিরের দরজা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। কেয়ারটেকার একটি কাঠশিল্পী পরিবার, যিনি দেখলাম ঠাকুরের আসন ও টুক-টাক আসবাব বানাচ্ছেন।

মন্দিরের ভেতর পাশাপাশি তিনটি ঘর, মাঝের ঘরে বেদির ওপরে বিগ্রহ। আমি বিশেষ একটা সহায়তা পাই নি, তাই সেই দালানে ওঠাও হয় নি, এবং বিগ্রহের ছবিও তোলা হয় নি। মন্দির দালানের বেশ ভগ্নদশা দেখলাম। তিনটি ঘরের বাইরে দেওয়ালে রয়েছে অযত্নে প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া অনেকগুলো দেওয়ালচিত্র (Fresco), যাতে মূলতঃ রাধা-কৃষ্ণের লীলা বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শিব-দুর্গা, নন্দী-ভৃঙ্গি, রাম-সিতা এবং শ্রীচৈতন্যের নানান বিষয়বস্তুগত রঙিন চিত্র।

একশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই ফ্রেসকোগুলো অযত্ন ও সংস্কারের অভাবে যেভাবে ধ্বংস হয়ে এসেছে, তাতে খুব বেশিদিন আর টিঁকবে বলে মনে হলো না। পুরো জেলাতে এটিই একমাত্র প্রাচীনতম ফ্রেসকো। 

এই অমূল্য সৃষ্টির রচয়িতার সম্পর্কে জানা যায়, তাঁর নাম 'দুর্গারাম ভাস্কর'। পূর্বদিকের অলিন্দে একটা ছোট্ট ছড়া লেখা আছে তার নামে -
"অতি দিন হীন ভক্ত জন
দুর্গারাম ভাস করেন : চিত্রকরেণ"

অবিভক্ত বাংলায় একদল চিত্রকরের উপাধি ছিল ভাস্কর, যাদের পূর্বপুরুষরা মূর্তি-গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীকালে পেশার বিলুপ্তির কারণে এনারা ছবি আঁকাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন, কিন্তু পদবি রয়ে যায় ভাস্করই। সেরকম একজন অনামি ভাস্কর, দুর্গারামের উৎকৃষ্ট প্রতিভার নমুনা বেঁচে আছে এই নন্দকুমার বসুর শ্যামসুন্দর জিউ মন্দিরের দেওয়ালচিত্রের মাধ্যমে।

ছবি: স্টেশনের ছবি সংগৃহিত, বাকি ছবি নিজস্ব।

তথ্যসূত্র:
১. 'বহড়ু' : কালিদাস দত্ত
২. দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার পুরাকীর্তি : সাগর চট্টোপাধ্যায়

Comments

  1. Very wonderful and interesting write-up

    ReplyDelete
    Replies
    1. Sotti ekhon o amra kato kichu e jani na kintu apnar janno tar kichu kichu itihas jante pari

      Delete
  2. অনবদ‍্য পুরাকীর্তির অবহেলা ও সংরক্ষনের অভাব পরিস্ফূট।। কালের গর্ভে ধীরে ধীরে এর বিলীন হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।। খুবই দুঃখজনক।। ফ্রেসকোগুলির বর্তমান দশা দেখে খুবই খারাপ লাগল। তবে মাত্র শখানেক বছরেই এই অসাধারণ ঐতিহ‍্যের চিরস্থায়ী ধ্বংস স্বীকার করে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ অজন্তা, কিংবা স্পিতির তাবোতে ফ্রেসকোর বয়স হাজার হলেও তা এখন ও অনেকটাই অমলিন। বসু পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের এ হেন আত্মঘাতী মনোবৃত্তি তে কত উৎকৃষ্ট কলা ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল...😢

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ ঐতিহাসিক প্রতিবেদন।

    ReplyDelete
  4. সত্যি আমাদের এখানেই কতকিছু আছে। 🙏👍😊

    ReplyDelete
  5. অনবদ্য লেখা

    ReplyDelete
  6. Its good to read and know about unknown facts.

    ReplyDelete
  7. এই বছরই মোয়া আনতে বহড়ু যাওয়ার কথা উঠেছিল কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হলো না। যা হয় ভালোই হয়। আপনার এই অসামান্য প্রতিবেদন পড়ে ইচ্ছে রইলো প্রাচীন এই দেওয়ালচিত্র একবার স্বচক্ষে দেখে আসার। শীতের অপেক্ষা ততোদিন। ধন্যবাদ আপনাকে। মোয়াটা পাওনা রইল।

    ReplyDelete
  8. সুন্দর লেখা! শুধু একটা প্রশ্ন - ঐ দেওয়াল চিত্র যে ফ্রেস্কো, সেটা নিশ্চিত হলেন কি করে? টেম্পেরাও তো হতে পারে!

    ReplyDelete
  9. খুব ভালো একটা লেখা পড়লাম।জানতাম না। ফ্রেস্কোর কাজ অসাধারন লাগে।তবে ওই সংরক্ষণের অভাবে সব নষ্ট।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।ছবি গুলোও খুব সুন্দর তোলা হয়েছে।

    ReplyDelete
  10. Obak bepar Jaipur ar planning akjon Bengali Vidyadhar Bhattacharya korlo sekhane 400..500 bochor purano jinis sonrokhito and bhalo charge korche segulo dekhar jonno. Log vir kore dekche akta gota tourism industry cholche ai vaskorjo dekhar jonno but akhane kono chestai nai agulo songrokhon jonno.

    ReplyDelete
  11. এমন ভাবে অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেলো ভেবে খারাপ লাগছে। হেরিটেজ এ ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।

    ReplyDelete
  12. আমরা আমাদের ঐতিহ্য বা ইতিহাস কে কেন যে এত অবহেলা করি..

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জন্নত-এ-জাকারিয়া : রমজানের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে ইফতারের খানা-খাজানার ইতিহাস (Jannat-e-Zakaria : a brief history of the Iftar foods available at Zakaria Street in Ramzan time)

একটা ঘড়ি, গেট আর এক বিস্মৃত রাজকুমার (The Ghari Ghar Gateway and a forgotten Prince)

নিমতলা আর নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদের গল্প (The story of Nimtala and Niyamathullah Ghat Mosque)