ফাস্টফুডের দোকান আর কোলকাতার তিনটি বিখ্যাত বিদেশি ফাস্টফুডের গল্প (Fast-food Stalls and story of three famous foreign fast foods of Kolkata)
আমি দক্ষিণ কোলকাতার কুদঘাট অঞ্চলের বাসিন্দা। নিজের যে ছোটবেলার সময়টায় কথা বলছি, তখন কুদঘাট হয়ে ওঠেনি 'নেতাজি মেট্রো স্টেশন', সেটা ছিল শুধুই একটা প্রান্তিক বাস ডিপো।
বাস ডিপোটা তখন আজকের মতো এতো ঝকঝকে ছিল না। বাসরাস্তার ধারেই আছে টালিনালা (আজ তার উপরে হয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন), যা বর্তমানে খালের রূপ নিয়েছে । এই খালের ধারে সারবেঁধে ছিল অনেকগুলো ফুডস্টল... নিচে একটা কাঠের বাক্স, আর তার ওপরে কাঠের ফ্রেমে ছাদ করে, সামনে একটা ঘোলাটে কাঁচ দিয়ে কিছুটা আবরণ দেওয়া। আমরা এদের ডাকতাম রোল চাউএর দোকান বলে।
সন্ধ্যা হলেই দোকানগুলো সামনে একটা উজ্জ্বল বাল্ব ঝুলিয়ে আর রাস্তায় কয়েকটা বেঞ্চ পেতে, সেজে উঠতো রোজকার বিক্রি-বাট্টার জন্য। পাড়ার চাকরি না পাওয়া ছেলেটা, সারাদিন খেটে আসা পাশের পাড়ার মন্টুদা, অথবা রিটায়ারমেন্ট হয়ে যাবার পরে বাড়িতে খাবারের বিধিনিষেধ টপকে রাস্তার খাবারের স্বাদ নিতে আসা বিভাসজেঠু এসে বেঞ্চে বসে বলতেন -
"কই রে বিল্টু, দে তো এক প্লেট এগ চাউ!"
কখনো বা ডিপোতে ফিরে আসা ২০৮ বাস থেকে কন্ডাক্টরকাকু নেমে এসে হাঁক দিতেন - "জলদি দুটো এগরোল বানা, বাস ছেড়ে দিতে হবে... টাইম হয়ে গেছে!"
ছোটবেলা আমার জগৎটাও ছোট ছিল, তাই এই দোকানগুলোর প্রতি অনেক বেশি আকর্ষণ অনুভব করতাম। মাঝে মাঝেই বাবার কাছে বায়না করতাম, ওই দোকানগুলোর থেকে খাবার জন্য! তখন স্বাভাবিকভাবেই ফাস্ট ফুড না খেতে দেবার জন্য, মা বলতেন "ওখানে খেতে হবে না, আমি বাড়িতে বানিয়ে দেব!" তাতেও কাজ না হলে, তখন বলতেন "ওরা কিন্তু কেরোসিন তেল দিয়ে রান্না করে, পচা কুমড়োর সস দেয়!" এতো কিছু করেও যখন আমার অশ্রুজলে ভেসে গিয়ে পরাস্ত হতেন, তখন পেতাম কুদঘাটে গিয়ে খাবার অনুমতি! একটু বড়ো হয়ে যখন দূরে দূরে টিউশন পড়তে যেতে শুরু করলাম, তখন আর কোনো অনুমতি নিতে হতো না!
তখনো মোবাইল ফোনের চল হয়নি কোলকাতায়। সন্ধ্যার পরে রোলের দোকানের সামনে চেনা অচেনা বিভিন্ন ধরণের মানুষরা ভিড় করতেন, এবং আড্ডা হতো। আমার মতো টিউশন-ফেরত পাবলিকও থাকতো কিছু! কুমড়োর সস দেওয়া এগরোল কিংবা কালো ভিনিগার দেওয়া চাউমিন.. এগুলোর সাথে মিশে থাকতো বড়ো তাওয়াতে খুন্তির টং টং শব্দ, আড্ডাবাজদের গল্প, ফ্রাই করার চিট-পিট শব্দ, আর গাড়ির হর্নের আওয়াজ। আমি মুখ দিয়ে খাবারগুলো খেতাম, আর কান দিয়ে ওই শব্দগুলো গিলতাম! দুটো মিলেমিশে, আমার পাকস্থলীতে জমা হতো সব!
মোমো কিন্তু কুদঘাটে এসেছে কিছুটা পরে। তার আগে মোমো খেতে হলে যেতে হতো হয় টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে, নাহলে রাণীকুঠি-নেতাজিনগর। কুদঘাটের মোমোর সাথে আমার বিশেষ সখ্যতা হয়নি, কারণ মোমোর থেকে বেশি স্যুপের প্রেমে পড়ি আমি! কুদঘাটের দোকানের স্যুপ আমার ভালো লাগতো না। আমার পছন্দের মোমো ছিল দেশপ্রিয় পার্কের সামনের 'রুম সুম মোমো সেন্টার', যার স্যুপ আমাকে চুম্বকের মতো টানতো! এক টুকরো চিকেন মোমোর সাথে এক চামচ উষ্ণ স্যুপের যুগলবন্দি, সাথে ফুটন্ত স্যুপের বাষ্পীয় গন্ধ... এক কথায় জাস্ট Awesome!!
আচ্ছা যে খাবারগুলো নিয়ে আমি এতক্ষণ কথা বলছি, সেগুলো কোলকাতার জনপ্রিয় ফাস্টফুড হলেও, এর একজনেরও জন্ম কিন্তু হয়নি কোলকাতাতে। চলুন, সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক এদের ইতিহাস।
প্রথমে বলি এগরোলের গল্প। অনেকেরই ধারণা, নিজামের কাঠি রোল থেকেই এসেছে সস্তায় বানানো এগরোল, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এগরোলের উৎপত্তি কিন্তু ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি, এবং চীনের ক্যান্টন প্রদেশের স্প্রিং রোল থেকেই এর উৎপত্তি। চিনেরা যখন জীবিকার সন্ধানে ঊনবিংশ শতকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করে, তারাই এই স্প্রিং রোলের পরিবর্তন ঘটিয়ে, ডিমের ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলে এগরোল! তাই একে পুরোপুরি চিনে না বলে, আমেরিকান-চাইনিজ বলাই ভালো।
চট-জলদি বানানো এবং সস্তায় পথচলতি খাবার হিসেবে এগরোলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে তারপর। তবে কোলকাতায় এগরোলের ব্যবহার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে, ডিম-পরোটার আরেক রূপ হিসেবে অচিরেই এটি জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আজও যদি পথচলতিতে খিদে পায়, আমাদের ফাস্টফুড হিসেবে এগরোলের কথাই মনে পড়বে প্রথমে। আমার এক আত্মীয় দাদা তো তার গার্লফ্রেন্ডকে (বর্তমানে বউ) প্রথম ডেটে নিয়ে গিয়ে, পিপিনের এগরোল খাইয়েছিল!
এবার আসা যাক চাউমিনের বিষয়ে। শব্দটা আসলে কিন্তু চাউমিয়েন (Chow mein), যেটা লোকমুখে হয়ে গেছে চাউমিন! এই খাবারটির জন্ম চীনের তাইশান (Taishan) প্রদেশে, তাই একে পুরোপুরি চিনে খাবার বলা চলে! চাউমিনের সাথে কিন্তু আরেকটা খাবারের খুব সাদৃশ্য আছে, সেটা হলো ইতালিয়ান পাস্তা!
তাইশানে জন্ম হলেও, বিভিন্ন অঞ্চল প্রভেদে বদলেছে চাউমিনের রূপ ও স্বাদ। কোথাও সে খুব মশলাদার, আবার কোথাও সে হালকা মশলাযুক্ত। নুডলের সাইজেও ঘটেছে হেরফের।
কোলকাতাতে চাউমিন নিয়ে আসে চিনেরা। অছিপুর থেকে যখন চিনেরা বউবাজার-টেরিটিবাজার-চাঁদনীচক অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করলো, তখন চিনেদের রেস্তেরার মাধ্যমে কোলকাতায় চাউমিনের চল হল। সময়ের সাথে চিনেরা ছড়িয়ে পড়লো তপসিয়ার দিকে, গড়ে উঠলো নিউ চায়নাটাউন।
তবে এই প্রসঙ্গে বলি, পুরোনো চায়নাটাউন অঞ্চলে বেশিরভাগ লোকজন ক্যান্টনিজ, তাই এখানে চাউমিনের স্বাদ আলাদা। কিন্তু নতুন চায়নাটাউনে বেশিরভাগ লোক হাক্কা, তাই তাদের স্পাইসি চাউমিনের সাথে আমাদের গলির দোকানের চাউমিনের স্বাদের মিল পাওয়া অনেক সহজ।
মোমো কিন্তু এদের থেকে একটু আলাদা। একটা সময় ছিল, মোমো মানে আমরা জানতাম উত্তরবঙ্গের অঞ্চলগুলো, বা নেপাল, সিকিম এসব। এটি কিন্তু আদতে একটি তিব্বতি লোকাল ফুড, যা আজ পৃথিবীর প্রায় ৬০% দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে! তিব্বতি ভাষায় মো (Mo) মানে বাষ্প।
তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীদের সাথে প্রথমে নেপালে আসে মোমো। এটাকে চাইনিজ বাওজি বা জিয়াওজি, মঙ্গোলীয় বাজ, কোরিয়ার মান্ডু বা জাপানের গিয়োজার সাথে তুলনা করা যায়। তিব্বতীয়রা স্থানীয় ভাষায় মোমোকে 'মগমগ' বলে।
নেপালে মোমোর কিছুটা পরিবর্তন করে, এর পুর হিসেবে দেওয়া হতো মহিষের মাংস, যেহেতু নেপালে মহিষ সহজলভ্য। পরবর্তীকালে কাঠমান্ডু থেকে ব্যাপক দেশান্তর (Migration) এবং মুক্ত অর্থনীতির কল্যাণে, ২০০০ সালের মাঝামাঝি ভারতের সমস্ত মেগাসিটিতে এই খাবারটি ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের মধ্যেই এই মোমো আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহু প্রবেশ করে। একটি দেশের কোনো লোকাল খাবার সাধারণত এতটা জনপ্রিয়তা পায়না, যতটা মোমো পেয়েছে।
কোলকাতায় এখন অনেক ফুটপাথের মোমোর দোকান ছাড়াও, প্রচুর মোমো জয়েন্ট গড়ে উঠেছে। কোলকাতাতে মূলত চিকেন ও ভেজ, দু'রকম মোমো বিখ্যাত। তবে আজকাল মোমো নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট দেখতে পাচ্ছি, যেমন পনির মোমো, চকলেট মোমো, ফিস মোমো ইত্যাদি।
সময়ের সাথে সাথে এখন আমার জগৎটা বড়ো হয়েছে, আর দুনিয়াটাও বদলে যাচ্ছে। 'রুম সুম মোমো সেন্টার' ধুঁকতে শুরু করলো, সাথে খাবারের গুণমানও পড়তির দিকে যেতে লাগলো। রোল-চাউমিনের দোকানে এখন শুধু অল্পবয়সীদের ভিড়, খাবারের অর্ডার দিয়ে যারা নিজেদের মধ্যে গল্প করার পরিবর্তে মোবাইলে ডুবে থাকে। কুদঘাটে মেট্রো চালু হবার পর, সন্ধ্যার পরে খুব একটা বাস যাতায়াত থাকে না, তাই আর কোনো কন্ডাক্টরকাকুও এসে এগরোল চায় না। অনেক নতুন নতুন দোকান হয়েছে, যেখানে এই রাস্তায় বেঞ্চে বসে আড্ডা দিয়ে খাওয়া জিনিসটাই তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন যারা দোকানে আসে, তারা নিজেদের মতো করেই খায়... কখনো বা খেতে খেতে গল্প করে। কালের স্বাভাবিক নিয়মেই একটা সময় হারিয়ে গেছে, অনেক সময়ের মাঝে....
ছবি সহায়তা: সমস্ত ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
তথ্যসূত্র:
১. Andrew Coe; Chop Suey: A Cultural History of Chinese Food in the United States.
২. Diana Huynh; The origin of Egg Rolls.
৩. Foodtimeline.org
৪. chefsambrano.blogspot.com/2012/01/history-of-chow-mein.html?m=1
৫. wikipedia.org/wiki/Chow_mein
৬. wikipedia.org/wiki/Egg_roll
৭. wonderopolis.org/wonder/whats-in-an-egg-roll
৮. vanskitchen.com/origin-of-the-egg-roll/
৯. nearsay.com/c/270775/262391/the-origin-of-egg-rolls-surprising-history-of-a-chinese-takeout-favorite
১০. wikipedia.org/wiki/Momo_(food)
১১. food.ndtv.com/food-drinks/the-story-of-momos-what-makes-this-tibetan-dumpling-so-popular-1397480
১২. sangbadtv.com/2019/08/21/find-out-where-the-momo-came-from-and-how-it-took-such-a-place-in-the-minds-of-the-bengalis-with-the-royal-momo-recipe/
১৩. charpoka.org/2018/07/05/momo/
Excellent..
ReplyDeleteভীষন ভালো লাগলো পড়ে। Egg roll এর এই ইতিহাস জানা ছিল না। আরোও গল্প শুনতে চাই। অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteAwesome write up .. keep it up
ReplyDeleteKono kichur itihas jante khub bhalo lage. Atao khub bhalo laglo.
ReplyDeleteKhub bhalo laglo pore
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। কতকিছু জানলাম।
ReplyDeleteLove it! Pipin south Kolkata ar akta emotion and oder mete diya chow ta osadharon chilo
ReplyDeleteভাই, খুবই সুন্দর ও সাবলীল বর্ণনা। ভালো হোক।
ReplyDeleteআহা, জিবে আসে জল, কী অসাধারণ বর্ণনা, এমনই চলতে থাকুক।
ReplyDeleteআমিও আদতে কুদঘাট অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলাম তাই ওই ছোট ছোট দোকান গুলোর স্মৃতি আজও আমাকে ওই দিকে গেলেই টেনে নিয়ে যায়, তথ্য গুলো অসাধারণ, এই ভাবেই আরো অনেক বিষয়ে লিখুন @*🙏👌❤
ReplyDeleteকুদঘাট - এই শব্দটা আমায় সবসময় টানে।সেই S2,4A এর বাসস্ট্যান্ডের ছবিটা চোখের সামনে চলে এলো। খাবারের ইতিহাস খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete