পুরোনো কোলকাতার এক জমিদার, এবং কোলকাতার কৈলাসধামের গল্প (Story of an old Zamindar and Bhukailash Rajbari)
খিদিরপুর বলতেই আমাদের মনে আসে ফ্যান্সি মার্কেট, ভিড় রাস্তা, লোহার কন্টেনার বহনকারী ট্রেলার, আর কোলকাতা পোর্ট! কিন্তু অনেকেই জানেন না, এখানে আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে, ছিলেন এক মানবদরদী ও প্রতাপশালী জমিদার, যিনি তার জনহিতকর কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, আর কয়েকটি মন্দিরের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন মর্ত্যভূমিতে কৈলাস।
খিদিরপুর ট্রামডিপোর উল্টোদিকের রাস্তায় আছে একটি নবনির্মিত উঁচু প্রবেশদ্বার। সেখান দিয়ে ঢুকে, অপরিচ্ছন্ন এক রাস্তা দিয়ে এঁকে বেঁকে গিয়ে, পৌঁছাতে হয় ভূকৈলাশ রাজবাড়িতে (Bhukailash Rajbari)। আজকের গল্প এই বাড়ির এক প্রতাপশালী জমিদার, জয়নারায়ণ ঘোষালকে (Maharaja Joy Narayan Ghoshal) নিয়ে।
ভূকৈলাস রাজবংশের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা জয়নারায়ণ ঘোষাল, যার জন্ম হয় ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে, গড়গোবিন্দপুর অঞ্চলে (বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়ামের অঞ্চল)। ওনার পিতামহ কন্দর্প ঘোষাল ছিলেন আদপে হাওড়ার বাকসারা গ্রামের বাসিন্দা। নবাবের অধীনে চাকরি করা ছাড়াও, নুনের ব্যবসা ছিল কন্দর্প ঘোষালের। পরবর্তীকালে ইংরেজরা গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির কাজ শুরু করলে, তারা প্রথমে বাকসারা চলে যান, ও পরে খিদিরপুরে এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন।
জয়নারায়ণ ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সংস্কৃত, আরবি, ফার্সী, বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি ছিলেন সুদক্ষ। প্রথমদিকে বাংলার নবাব নাজিম মোবারকউদৌল্লার দরবারে চাকরি করলেও, অসন্তুষ্টির জন্য পরে তা ছেড়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কোলকাতা, যশোর ও ঢাকাতে তিনি দক্ষতার সাথে কাজ করেন। তার কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে, লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে "মহারাজা বাহাদুর" খেতাব পেতে সাহায্য করেন, এবং ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে তাকে তিন হাজারি বা সাড়ে তিন হাজারি মনসবদারের সনদ এনে দেন।
চাকরির সাথে সাথে জয়নারায়ণ নুন, ও ধন-রত্নের ব্যবসা চালিয়ে যান, যা একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। খিদিরপুরে পৈতৃক বাসভবনের কাছে কালিবাগান অঞ্চলে ১০৮ বিঘা (মতান্তরে ১৮০ বিঘা ও ২০০ বিঘা) জমি কিনে, পরিখাবেষ্টিত এক চমৎকার প্রাসাদ বানিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই শিবগঙ্গা নামে একটি দীঘি খনন করান, এবং দীঘির তীরে রক্তকমলেশ্বর আর কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর শিবমন্দির নির্মাণ করান।
তিনি শিক্ষার প্রসার ও বিভিন্ন জনহিতকর কাজেও অংশগ্রহণ করেন। খিদিরপুর অঞ্চলে তিনি ইংরেজি ও ফার্সী শেখার জন্য স্কুল খুলেছিলেন। তিনি নিজেও বাংলা এবং সংস্কৃততে কয়েকটি বই লিখেছিলেন, এবং কয়েকটি বই সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কাশীতে বিদ্যালয় তৈরি, হিন্দু কলেজ তৈরি, মায়ো হাসপাতাল নির্মাণে, অনাথ আশ্রম তৈরিতে-- তার ভূমিকা ছিল। সেন্ট জনস চার্চ তৈরির সময় তিনি পাঁচশ টাকা দান করেছিলেন, বাইবেল সোসাইটিকে দিয়েছিলেন একশ টাকা। অর্থাৎ বাংলার বুকে যে নতুন শিক্ষার ও উন্নতির আলোড়ন, তাতে যথেষ্ট প্রভাব ছিল ওনার।
এবার ফিরে আসি বর্তমানে। আজকে সেই রাজবাড়ীর কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ভাগাভাগি করতে করতে, রাজবাড়ীর স্মৃতি হিসেবে বেঁচে আছে কয়েকটি গোলাকার লম্বা থাম। দীনবন্ধু মিত্রের লেখায় রয়েছে সেই বাড়ির বর্ণনা -
"ভুবনে কৈলাস-শোভা ভূকৈলাস ধাম
সত্যের আলয় শুদ্ধ সত্য সব নাম,
চারিদিকে কাটাগড় কেমন সুন্দর
খিলানে নির্মিত সেতু, বর্ত্ম পরিসর..."
শুধু রয়ে গেছে দুটি শিবমন্দির, আর কুলদেবী পতিতপাবনীর মন্দির।
নহবতখানা পেরিয়ে ঢুকতে হয় রাজবাড়ীর ভিতরে। সোজা চলে গেলে চোখে পড়বে দুটি বৃহদকায় শিবমন্দির, ও একটি বাঁধানো দীঘি। কোলকাতাতে মিউনিসিপালিটির তত্ত্বাবধানে মন্দিরদুটি ও পুকুরের সংস্কার হয়েছে।
১৭৮১ তে শিবগঙ্গা (Shiva Ganga) খোদিত হয় এবং এই বিশাল আটচালা রীতির যমজ শিবমন্দিরদুটি (Shiv Temples) স্থাপিত হয়। জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর মাতা-পিতার নামানুসারে, ত্রি-খিলানযুক্ত আটচালা মন্দির দুটির পূর্ব দিকের মন্দিরের শিবলিঙ্গের নাম রাখেন রক্তকমলেশ্বর (Raktakamaleshwara)। হুবহু গঠনশৈলীর দ্বিতীয় মন্দিরটির শিবলিঙ্গের নাম নাম কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর (Krishnachandreshwara)। ১৮ ফুট উচ্চতার একেকটি করে, কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ (Shiva Linga) বানানো হয়েছিল একটি মাত্র পাথর কেটে, যা ভারতের উচ্চতম শিবলিঙ্গ। দুটি মন্দিরের মাঝখানে প্রমাণ সাইজের নন্দী অর্থাৎ শিবের বাহন (ষাঁড়ের মূর্তি)।
সংস্কারের পর মন্দিরগাত্রের কারুকাজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে উঁচু চাতালের ওপর উঠে ভিতরে প্রবেশ করলে দেওয়ালের উপরের দিকে কিছু কাজ নজরে আসে। কথিত আছে জয়নারায়ণের সহৃদয় সাধক রামপ্রসাদ এই মন্দির দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে বলেন, কৈলাশ থেকে শিব স্বয়ং নেমে এসেছেন। সেই থেকে জয়নারায়ণ ঘোষালের এই ভূসম্পত্তি ভূকৈলাস (Bhukailash) নামে খ্যাত হয়।
দীঘির ওপারে রয়েছে জয়নারায়ণ ঘোষাল স্মৃতি মন্দির, তাতে রাজা জয়নারায়ণের উপবিষ্ট মূর্তির হাতে রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে উপবীত ও পায়ে খড়ম। এই স্মৃতিমন্দিরটি নিয়মিত খোলা হয় না। সংস্কারের পর দীঘির চারদিকে ছোট ছোট ছটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে, যা পরপর গণেশ, রাম-সীতা, হনুমান, সরস্বতী, রাধা-কৃষ্ণ ও দেবী দুর্গার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, এই মূর্তিগুলি রাজস্থান থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে।
শিবমন্দিরগুলোর পাশেই রয়েছে ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঘোষালবংশের কুলদেবী পতিতপাবনীর মন্দির (Maa Patitpabani Durga)। জয়নারায়ণ দিল্লির বাদশা মহম্মদ জাহান্দার শাহের কাছ থেকে 'মহারাজা বাহাদুর' খেতাব ও মনসবদারি পান, মন্দির চত্বরে উপস্থিত দুটি কামান সম্ভবত সেটার সাক্ষী দিচ্ছে।
গ্রিক, মুসলিম ও হিন্দু স্থাপত্য আঙ্গিকের মিশেলে দালান রীতিতে দুর্গামন্দিরটি নির্মিত, আর চারদিকে চারটি পৃথক মন্দিরে অবস্থান করছেন মকরবাহিনী গঙ্গা, পঞ্চাননদেব, রাজরাজেশ্বরী এবং মহাকাল ভৈরব। মন্দিরটির এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কুলদেবী সরাসরি দেখতে পান পুষ্করিণীর পাশের শিবমন্দির এবং রাজপ্রাসাদ। পতিতপাবনী দুর্গার মূর্তি অষ্টধাতু নির্মিত, ঘোটকাকৃতি সিংহারূঢ়া মহিষাসুরমর্দিনী দশভুজা রূপে।
মন্দিরে বেশ কয়েকটি ফলক রয়েছে, যেখান থেকে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার তারিখ পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে জয়নারায়ণের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তবে এই ফলকের ব্যাপারে দুটো জিনিষ আমি লক্ষ করেছি, সেটা আলাদাভাবে উল্লেখ করবো।
প্রথমতঃ, অষ্টাদশ শতাব্দীর তৈরি কোনো মন্দিরে ইংরেজি ও ফার্সীতে লেখা ফলক দেখি একমাত্র এখানেই। আর কোলকাতার এখন পর্যন্ত কোনো মন্দিরে আমি এই দুই ভাষার ব্যবহার হতে দেখি নি। এতে প্রমাণ হয়, রাজভাষা হিসেবে ইংরেজি ও ফার্সী কতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই সময়ে।
দ্বিতীয়তঃ, বেশিরভাগ ফলকেই দেখা যায়, রাজার কীর্তি ফলাও করে লেখা আছে, কিন্তু সেটা কে সম্পাদন করেছে আর কে যে খোদাই করেছে, সেই মানুষগুলো অন্ধকারে থেকে যায়। এখানে মন্দিরের একটা প্রায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া ফলকে রয়েছে জয়নারায়ণ ঘোষালের বংশের বৃত্তান্ত। পুরো লেখাটার নীচে খোদাই করা রয়েছে সম্পাদক ও খোদাইকরের নাম....
"শ্রী রাধানাথেন সম্পাদিতম" এবং "শ্রীযাদবচন্দ্র ভাস্করেণ খোদিতং"।
আজকে একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে... সেই সময়ের এই দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তবে এখন আর জয়নারায়ণকে কেউ মনে রাখেনি। মন্দিরের শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে –
‘মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল বাহাদুর সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, আরবী, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর সাহিত্যিক অনুরাগ ও কবিত্ব শক্তির জন্য তিনি রাজকবি হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন। তদানীন্তন পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট জন শেক্সপিয়রের সময় তিনি সরকারি সুপারিন্টেডেন্টের পদ গ্রহণ করে শৃংখলার সঙ্গে সুশাসনের প্রবর্তন করেন। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্য জ্ঞানী ও গুণিজনের সঙ্গে নানা হিতকর কাজ করেন।’
তবে এই লেখাতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গটি ভুল লেখা আছে। এর কারণ যে সময়ে জয়নারায়ণ মারা যান, সেই সময়ে বিদ্যাসাগর নিতান্তই শিশু।
তথ্যসূত্র:
১. কলিকাতা সেকালের ও একালের : হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
২. কলিকাতা দর্পণ; রাধারমণ মিত্র
৩. বনেদি কোলকাতার ঘরবাড়ি : লেখা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
৪. bengali.indianexpress.com/west-bengal/bhu-kailash-temple-of-kolkata-khidirpur-101239/lite
৫. amitavghosh.com/blog/?p=157
৬. a-tribute-to-maharaja.blogspot.com/2010/09/in-auspicious-event-of-sandhi-puja-in.html?m=1
আমরাও তো গিয়েছি কিন্তু ডকুমেন্ট রাখার প্রয়োজন উপলব্ধি করিনি। আজকে আপনি যে ডকুমেন্ট তৈরিতে ব্যাপিত আছেন, ভবিষ্যতে তা এক অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হবে।
ReplyDeleteThank you Sir!
Deleteএকদম ঠিক কথা বলেছেন।
DeleteAmi ekhane gachi, Alpo history o sunechilam but eto kichu jantam na, Eibhabe e tumi nige o jano songe amader o janao ❤❤
ReplyDeleteকি যে ভালো লাগলো বলে বোঝাতে পারব না। জানা ছিল না। জেনে খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteভুকৈলাশ নিয়ে আপনার এই লেখাটি এক অমূল্য সম্পদ। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন সবাই। অসংখ্য ধন্যবাদ ।।
ReplyDeleteযে ভাস্কর খোদাই করেছিলেন তিনি কি দাঁইহাটের......আর নদিয়ার শিবনিবাসের শিব ও বেশ বড়.......
ReplyDeleteআপনার এই ইতিহাস চয়ন এক কথায়
ReplyDeleteআপনার এই ইতিহাস চয়ন অভূতপূর্ব, আন্চলিক ইতিহাস রচনার এক মাইল ফলক
ReplyDeleteসমৃদ্ধ হলাম, নেহাৎ হেলাফেলার নয় তবু কালের অতলে হারিয়ে গেছে। যা এভাবেই লেখার মাধ্যমে সংরক্ষিত হতে পারে। আপনাকে সাধুবাদ জানাই 🙏
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো দাদা। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এই সুন্দর ও তথ্যবহুল পোস্টের জন্য ♥️🥀
ReplyDeleteভালো লাগল।
ReplyDelete